বই আলোচনা
শিলিগুড়ি সম্মেলনের উজ্জ্বল ও ধূসর দিক
মুক্তিযুদ্ধের একদম অনালোচিত এক অধ্যায় তুলে ধরেছে নাইনটিন সেভেনটি ওয়ান: দ্য শিলিগুড়ি কনফারেন্স: অ্যান আনটোল্ড স্টোরি অব দ্য লিবারেশন ওয়ার বইটি। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে যুদ্ধকৌশল ঠিক করা, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখা এবং রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। এসবের সমাধানে ভারতের শিলিগুড়িতে সামরিক-বেসামরিক নেত্বত্ব ও জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কিছু ধূসর ও উজ্জ্বল দিকে নজর ফেলেছে শিলিগুড়ি সম্মেলনের ওপর এই একমাত্র বইটি। ঘটনাটি নিয়ে দুই পর্বের আলোচনা করেছেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক মোহাম্মদ সাজ্জাদুর রহমান। আজ প্রকাশিত হলো শেষ পর্ব।
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের দ্বিতীয়ার্ধে পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র (রাজনৈতিক) দপ্তরের যে গোপন পাক্ষিক প্রতিবেদন১ তৈরি করা হয়েছিল, সেখানে উল্লেখ করা হয়,
‘এক গোপন খবরে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের কয়েকজন নির্বাচিত এমএনএ এবং এমপিএ ১৮ এপ্রিল ’৭১ ঢাকায় পিডিপিপ্রধান নুরুল আমিনের সঙ্গে তাঁর বাসভবনে সাক্ষাৎ করেছেন। তাঁরা দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেছেন। আরও জানা গেছে, নুরুল আমিনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন এবং স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনা ও রাজনৈতিক সমঝোতার বিষয়ে তাঁরা তাঁকে আশ্বস্ত করেছেন।’
এর পরের মাসেই একই দপ্তর থেকে প্রস্তুতকৃত গোপন প্রতিবেদনে২ উল্লেখ করা হয়,
‘এক গোপন সূত্রে জানা গেছে, ২৬ মে ’৭১ দলের নেতা–কর্মীদের সঙ্গে এক আলোচনায় নুরুল আমিন আশা প্রকাশ করেছেন যে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে তাঁকে নেতা মনোনীত করতে আওয়ামী লীগের ৭৫ জন এমএনএ ইতিমধ্যে সমর্থন দিয়েছেন।’
আবার জুন৩ মাসের প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়,
‘এটা শোনা যাচ্ছে, পিডিপিপ্রধান জনাব নুরুল আমিন বিশ্বাস করেন, দেশে পুরোপুরি স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত এমএলএদের সঙ্গে সমঝোতা দরকার। তাঁর মতে, যেসব এমএলএ বিদ্রোহের অবসান ঘটিয়ে সরকারকে সহায়তা করতে চান, তাঁদের অনুকূলে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় গতি আসবে। তাঁর উক্তি অনুযায়ী, তিনি আওয়ামী লীগের নির্বাচিত এমএলএ এবং এমপিএদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সর্বোত্তম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, যাতে তাঁরা সেনাবাহিনীর প্রতি শত্রুতা পরিহার করেন।’
১৯৭১ সালের জুলাই মাসের দ্বিতীয় পাক্ষিকের গোপন৪ রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়,
‘অন্য একটি তথ্যমতে, ময়মনসিংহ থেকে আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত এমপিএ (বর্তমানে পশ্চিম পাকিস্তানে) সৈয়দ বদরুজ্জামান এক বিবৃতিতে জানান, আওয়ামী লীগের কজন এমএনএ ও এমপিএ পাকিস্তান পিপলস পার্টিতে যোগ দিতে পারেন। তাঁর এই বিবৃতি পিডিপি মহলে বিস্ময় উপহার দিয়েছে।
শোনা যাচ্ছে, নুরুল আমিন তাঁর দলীয় নেতা–কর্মীদের কাছে এটা বলে দিয়েছেন যে কফিলউদ্দিন চৌধুরী, জহিরউদ্দীন, আসাদুজ্জামান খানসহ (তাঁরা সবাই নির্বাচিত এমএনএ) অনেক নেতা তাঁর সঙ্গে ইতিমধ্যে দেখা করে আনুগত্য জানিয়ে গেছেন। নুরুল আমিনের মতে, জুলফিকার আলী ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে পা রাখার সুযোগ সৃষ্টি করতে সৈয়দ বদরুজ্জামানকে কাজে লাগাচ্ছেন। শোনা যাচ্ছে, জহিরউদ্দীন ও আসাদুজ্জামান খানকে নুরুল আমিন বলেছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে যেসব এমএনএ ও এমপিএ থাকতে চাইছেন না, তাঁদেরকে বৈঠকে আহ্বান করে সিদ্ধান্ত জানাতে বলা হবে, তাঁরা কি নতুন কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দেবেন নাকি স্বতন্ত্র থেকে যাবেন, নাকি নিজেদের জন্য নতুন কোনো রাজনৈতিক মঞ্চ গড়বেন।'
এসব তথ্য থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট, তা হলো মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার প্রশ্নে ১৯৭০-এর নির্বাচনের মাধ্যমে আবির্ভূত পাকিস্তানের প্রধানতম দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন কি না, তা নিয়ে ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকেই রাজনৈতিক মহলে নানা আলাপ চলছিল। আর তাই প্রবাসী সরকারের কাছে জুলাই মাসের ওই সম্মেলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল—এই বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য যে তাদের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে সব পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে মতৈক্য রয়েছে।
‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ নামকরণ
বইটিতে সংকলিত নথিপত্রগুলোর মধ্যে যে বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়, তা হলো প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামারুজ্জামান এবং কমান্ডার ইন চিফ এম এ জি ওসমানীর মতো ব্যক্তিদের মনোভাব বোঝার জন্য ভারতীয় কর্মকর্তারা সচেষ্ট ছিলেন এবং তাঁদের বিস্তারিত সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন।
যুদ্ধ ও রাজনৈতিক পরিকল্পনা সম্পর্কে নেতাদের মতামত জানা ছাড়াও তাঁদের ব্যক্তিত্বের একধরনের মূল্যায়নও নথিপত্রে দেখা যায়। এই সম্মেলনে উপস্থিত অন্য প্রতিনিধিরা মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা কীভাবে মূল্যায়ন করছেন, সে ব্যাপারেও সংগৃহীত তথ্য প্রতিবেদনে স্থান পেয়েছে। মুক্তিফৌজের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্বের এবং আওয়ামী লীগের যুদ্ধকালীন নেতৃত্বের সঙ্গে ছাত্রলীগের তরুণ নেতাদের দূরত্বের প্রমাণও সংকলিত নথিপত্রে স্পষ্ট।
যুদ্ধকালীন এই সম্মেলনটি যে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গেই বিবেচিত হচ্ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় সেখানে গৃহীত ও আলোচিত কিছু সিদ্ধান্তের মধ্যেই। যেমন এই সম্মেলনের মাধ্যমেই ‘নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগে’র বিলুপ্তি ঘটে এবং ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগে’র নতুন নাম দেওয়া হয় ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’।
সামরিক প্রয়োজনে সমগ্র বাংলাদেশকে বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ করে সেগুলো বিভিন্ন সেক্টর ও সাবসেক্টরে বিভক্ত করার সিদ্ধান্তও এই সম্মেলনে আলোচিত হয়েছিল। ভারতের কাছ থেকে কী ধরনের সামরিক সহায়তা প্রয়োজন, তা বেশ স্পষ্ট করেই কর্নেল ওসমানী সম্মেলনে দাবি করেছিলেন। সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকারের বাজেট পাস করা সম্ভব না হলেও প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের জন্য মাসিক ভাতার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়। এর পরিমাণ নিয়ে প্রবল অসন্তোষের বিষয়টি নথিতে উল্লেখ করা আছে।
সম্মেলনের দুটি দিক
বাংলাদেশ সরকারের মূল নেতাদের চমৎকার গুণাবলি আর মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাঁদের অবিচল অঙ্গীকারের কথা ভারতীয় সামরিক বাহিনীর ওই তিন কর্মকর্তার প্রত্যেকের প্রতিবেদনেই স্থান পেয়েছে। তবে নথিপত্রগুলোতে যুদ্ধকালীন বাংলাদেশি নেতাদের প্রতি বিবিধ অভিযোগও লক্ষণীয়। এসব অভিযোগের সত্যতা কতটুকু, তা এ পর্যায়ে তদন্ত করা কঠিন হলেও যেটা স্পষ্ট তা হলো, আওয়ামী লীগের নেতাদের পারস্পরিক অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতার প্রকাশ্য রূপ দেখা গিয়েছিল সম্মেলনের মধ্যেই।
যেমন পেছনের দিকের বেশ কয়েকজন প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত নেতা অভিযোগ করেছিলেন যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিপুল পরিমাণ পাকিস্তানি মুদ্রা ব্যাংক লুটের মাধ্যমে ভারতে স্থানান্তরিত হওয়ার পর সেগুলো জ্যেষ্ঠ জনপ্রতিনিধিরা আত্মসাৎ করছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিফৌজের কাছে দেশের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় কি না, তা নিয়েও একধরনের অস্বস্তিকর আশঙ্কার উপস্থিতি ছিল।
তাই মুক্তিফৌজকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীন করার বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার দাবিও তোলা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের কেউ কেউ ছাত্রলীগের প্রতি অভিযোগ করছিলেন যে যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের গণহত্যার দায় তাদের ওপরেও বর্তায়। কারণ, তারাই ২৫ মার্চের আগে সারা পূর্ব বাংলায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে ইয়াহিয়াকে উন্মত্ত আক্রমণের পথ তৈরি করে দিয়েছে।
অন্যদিকে ছাত্রলীগের দাবি, মুক্তিফৌজের অধিকাংশই ছাত্রলীগের সদস্য এবং তাদের কষ্টের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জিত হলে দেখা যাবে আওয়ামী লীগের জনপ্রতিনিধিরাই সুবিধা নিচ্ছেন। এ ছাড়া জনাব কামারুজ্জামান এবং এম এ জি ওসমানীর নিয়োগের বিষয়টি নিয়েও অনেকের আপত্তি সম্মেলনে প্রকাশ পায়। বিশেষ করে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে এম এ জি ওসমানীর বিরুদ্ধে নকশালপন্থীদের মুক্তিফৌজের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক দায়িত্বে নিযুক্ত করার বিস্ময়কর অভিযোগও তোলা হয়েছিল। সব মিলিয়ে সম্মেলনের পরিস্থিতি নিয়ে ক্যাপ্টেন সুর্ভের মন্তব্যের (পৃ. ১১৯-১২০) বাংলা রূপান্তর অনেকটা এ রকম দাঁড়ায়,
`‘উপস্থিত প্রতিনিধিদের মধ্যে খুব কম দায়িত্বশীল ব্যক্তিই আছেন, যাঁরা সত্যিই পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারছিলেন। প্রতিনিধিদের বেশির ভাগই বেশ ভাবলেশশূন্য ছিলেন এবং মনে করছিলেন যে পুরো আয়োজনটি একটি দুর্দান্ত প্রমোদভ্রমণের বিষয়। এমএনএ এবং এমপিএদের মাসিক ভাতা কত বরাদ্দ হচ্ছে, তা নিয়েই বরং বেশি মাথাব্যথা লক্ষ করা গেছে। শিলিগুড়ির পার্থিব আনন্দের বিষয়গুলোই যেন সমাবেশের মূল আগ্রহ।’
বইটি সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও বেশ প্রাসঙ্গিক। এ ক্ষেত্রে প্রায় এক যুগ আগে কালের কণ্ঠ–এ প্রকাশিত৫ এক সংবাদভাষ্যের দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে,
‘পাকিস্তান গণপরিষদে নির্বাচিত এবং পরে দল থেকে বহিষ্কৃত ৪৩ জন আওয়ামী লীগ–দলীয় সদস্যের তালিকাটি সংসদ সদস্যদের তীব্র আপত্তির মুখে সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি থেকে এক্সপাঞ্জ করেছেন স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ। গতকাল বুধবার সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ওয়ারেসাত হোসেন বেলালের তারকা চিহ্নিত এক প্রশ্নের উত্তরে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ জানান, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচিত ৪৩ জন গণপরিষদের সদস্যকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তিনি সংসদকে আরও জানান, এসব সদস্যের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার কিংবা তা বহাল রাখা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার। এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের কিছু করার নেই। এ তালিকা প্রকাশের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, ইঞ্জিনিয়ার আবুল কাশেম, রওশন জাহান সাথী ও শামসুর রহমান শরীফ ডিলু। তাঁরা বলেন, এই তালিকা প্রকাশ সঠিক হয়নি। স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে যাঁদের নাম এ তালিকায় দেওয়া হয়েছে, তাঁরা অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নিয়েছেন। সুতরাং তা এক্সপাঞ্জ করা উচিত। আইনমন্ত্রীর উপস্থাপিত যুদ্ধাপরাধের দায়ে বহিষ্কৃতদের তালিকা প্রকাশ নিয়ে প্রথমেই প্রশ্ন তোলেন আওয়ামী লীগ দলীয় সিনিয়র সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ। পয়েন্ট অব অর্ডারে বক্তব্যের সুযোগ নিয়ে তিনি বলেন, এ প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে আসেনি। বহিষ্কৃত ব্যক্তিরা শুধু যুদ্ধাপরাধী হিসেবে নন, বিভিন্ন কারণে দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন, তাঁদের সবাই স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন—এটা ঠিক নয়। যাঁদের নাম তালিকায় এসেছে, তাঁদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নিয়েছেন। সুতরাং সংসদের কার্যবিবরণী থেকে এই প্রশ্ন প্রত্যাহার (এক্সপাঞ্জ) করে নতুন করে উত্তর দেওয়ার দাবি জানান তিনি। উল্লেখ্য, ওই সময় বহিষ্কৃত ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ কেউ এখনো আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন।’
অতিসম্প্রতি জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল ১৯৭০ সালে নির্বাচিত এমএনএ ও এমপিএদের মধ্যে যাঁরা পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন, তাঁদের তালিকা প্রণয়ন ও গ্যাজেট প্রকাশের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করার ক্ষমতাও পেয়েছে।৬
আরও তথ্য প্রয়োজন
সবশেষে বলা যায়, এ রকম গুরুত্বপূর্ণ একটি বইয়ে নির্ঘণ্ট থাকা জরুরি ছিল। একটি দালিলিক ইতিহাসের বই হিসেবে নথিপত্রের বিভিন্ন তথ্যের (যেমন ব্যক্তির নাম কিংবা ঘটনা) জন্য টীকা-টিপ্পনী দেওয়া থাকলে আগ্রহী এবং নতুন পাঠকদের কৌতূহল মিটত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কর্নেল এম এ জি ওসমানীর কোন ভাতিজা নকশালপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন, যাঁকে মুক্তিফৌজের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ করা হচ্ছিল; তা নিয়ে টীকা বা ফুটনোট থাকা প্রয়োজন ছিল।
তা ছাড়া মূল নথিপত্রের দু-একটি ছবি বইটিতে থাকলেও বেশ ভালো হতো। প্রতিবেদনগুলোর প্রাপক কে বা কারা এবং এসবের ভিত্তিতে কী ধরনের সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত নেওয়া হয়েছিল, তা এই আংশিক নথিপত্র থেকে বোঝার উপায় নেই। তবে এ ধরনের বহু প্রতিবেদন যে সে সময়ের ভারতীয় সামরিক ও বেসামরিক কর্তৃপক্ষ প্রস্তুত করেছিল, তা সহজেই অনুমেয়। এই বইয়ে উপস্থাপিত নথিপত্র প্রমাণ করে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার উপাদান এখনো নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছে। শিলিগুড়ি সম্মেলনকে কেন্দ্র করে এই দালিলিক ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি বোঝার ক্ষেত্রে অবশ্যপাঠ্য হিসেবেই বিবেচিত হবে। (শেষ)
লেখক পিএইচডি গবেষক, স্ট্রসলার সেন্টার ফর হলোকাস্ট অ্যান্ড জেনোসাইড স্টাডিজ, ক্লার্ক ইউনিভার্সিটি। ইউএসএ।
তথ্যসূত্র:
১. দেখুন, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের দ্বিতীয়ার্ধের পাক্ষিক গোপন প্রতিবেদন। পূর্ব পাকিস্তান সরকার, স্বরাষ্ট্র (রাজনৈতিক) অধিদপ্তর, সেকশন ১। আরিফুর রহমান (২০১৫) একাত্তরের গোপন দলিল। জাগৃতি প্রকাশনী, ঢাকা। পৃ. ২৯
২. দেখুন, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে ১৯৭১ সালের মে মাসের দ্বিতীয়ার্ধের পাক্ষিক গোপন প্রতিবেদন। পূর্ব পাকিস্তান সরকার, স্বরাষ্ট্র (রাজনৈতিক) অধিদপ্তর, সেকশন ১। আরিফুর রহমান (২০১৫) একাত্তরের গোপন দলিল। জাগৃতি প্রকাশনী, ঢাকা। পৃ. ৪১
৩. দেখুন, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে ১৯৭১ সালের জুন মাসের প্রথমার্ধের পাক্ষিক গোপন প্রতিবেদন। পূর্ব পাকিস্তান সরকার, স্বরাষ্ট্র (রাজনৈতিক) অধিদপ্তর, সেকশন ১। আরিফুর রহমান (২০১৫) একাত্তরের গোপন দলিল। জাগৃতি প্রকাশনী, ঢাকা। পৃ. ৪৫
৪. দেখুন, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের দ্বিতীয় পাক্ষিকে পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে গোপন রিপোর্ট। আরিফুর রহমান (২০১৫) একাত্তরের গোপন দলিল। জাগৃতি প্রকাশনী, ঢাকা। পৃ. ৭০
৫. কালের কণ্ঠ (২০১০) সংসদ সদস্যদের আপত্তির মুখে বহিষ্কৃত ৪৩ আ.লীগ নেতার তালিকা এক্সপাঞ্জ। ২৩ সেপ্টেম্বর। বিস্তারিত জানতে দেখুন, https://www.kalerkantho.com/ print-edition/campus/2010/09/23/89944
৬. দেখুন, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন ২০২২। 2022-09-20-11-55 55a3a24bbf2fa27578169cd029f2f456.pdf (jamuka.gov.bd)