২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

ঢাকায় এলোপাতাড়ি গুলি, দুই পক্ষের সংঘর্ষে যাঁদের মৃত্যু

স্বামীর মৃত্যুর খবরে হাসপাতালে কান্নায় ভেঙে পড়েন ভুবন চন্দ্র শীলের স্ত্রী রত্না রানী শীল। পাশে তাঁদের মেয়ে ভূমিকা রানী শীল। পপুলার হাসপাতাল, ধানমন্ডি, ঢাকা, ২৫ সেপ্টেম্বর
ছবি: আশরাফুল আলম

আর পাঁচটা দিনের মতোই কাজ শেষ করে বাসায় ফিরছিলেন ভুবন চন্দ্র শীল, যেমন ফেরে রাজধানীর লাখো মানুষ। উঠেছিলেন ভাড়ায় চালিত একটি মোটরসাইকেলে। ঢাকার তেজগাঁও পার হওয়ার সময় একটি গুলি এসে লাগে তাঁর মাথায়।

যে সন্ত্রাসীরা গুলি করেছিল, তাদের সঙ্গে ভুবনের কোনো বিরোধ ছিল না। কিন্তু তাদের ছোড়া এলোপাতাড়ি গুলিতেই সাত দিন হাসপাতালে অচেতন থেকে গত সোমবার প্রাণ হারান ভুবন। ভুবনহীন পৃথিবীতে তাঁর স্ত্রী রত্মা রানী শীল, মেয়ে ভূমিকা রানী শীল অসহায় হয়ে পড়লেন। ৭৫ বছর বয়সী মা গিরিবালা শীল হারালেন একমাত্র ছেলেকে।

অথচ কথা ছিল, মোটরসাইকেলে ভুবন চন্দ্র শীল দ্রুত বাসায় ফিরবেন। ফিরে হয়তো স্ত্রীকে ফোন করতেন, মায়ের ও মেয়ের খোঁজ নিতেন।

ভুবনের মতোই বাসায় ফিরছিলেন কলেজছাত্রী সামিয়া আফনান ওরফে প্রীতি (২২)। ২৪ মার্চ ২০২২, ঢাকার শাহজাহানপুরে সন্ত্রাসীদের ছোড়া এলোপাতাড়ি গুলিতে প্রাণ হারান সামিয়া। ২০১০ সালে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু বকর ছিদ্দিক।

স্ত্রী রত্না রানী শীল ও মেয়ে ভূমিকা চন্দ্র শীলের সঙ্গে ভুবন চন্দ্র শীল
ছবি: সংগৃহীত

একটু পেছনে, ২০০২ সালে গেলে পাওয়া যায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী সাবেকুন নাহার সনির নামটি, যিনি প্রাণ হারিয়েছিলেন ছাত্রদলের দুই পক্ষের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে। কদিন আগে, গত ২৮ জুলাই ঢাকায় আওয়ামী লীগের সমাবেশ শেষে দুই পক্ষের সংঘর্ষে ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান মাদ্রাসাছাত্র রেজাউল করিম।

ভুবন, সামিয়া, রেজাউল, আবু বকর, সনি—এমন নাম আরও পাওয়া যাবে। কোনো ঘটনার বিচার চলছে, কোনো ঘটনার বিচারই হয়নি। এমনকি কোনো ক্ষেত্রে কার গুলিতে নিরীহ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, তার হদিসই বের করতে পারেনি পুলিশ।

কিন্তু পরিবারগুলো তাদের স্বজন হারিয়েছে। কোনো কোনো পরিবার একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে নিদারুণ সংকটে পড়েছে। কোনো কোনো পরিবারের একটু সচ্ছলতার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেছে।

যেমন ভুবনের মৃত্যুর পর ঢাকার পপুলার হাসপাতালে তাঁর কান্নারত স্ত্রী রত্না রানী শীল বলছিলেন, ‘আমার মেয়েটা বাবাকে ছাড়া কিছু বুঝত না। তার বাবা নীরবে চলে গেল। আমার মেয়েটা এত অভাগা, তার ছোট ছোট স্বপ্নও আর পূরণ হলো না।’

রিকশায় ফিরছিলেন সামিয়া

সামিয়া আফনান
ছবি সংগৃহীত।

২০২২ সালের ২৪ মার্চ রাতে রাজধানীর শাহজাহানপুরে খুন করা হয় মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম ওরফে টিপুকে। ভাড়াটে খুনির ছোড়া এলোপাতাড়ি গুলিতে রিকশায় থাকা কলেজছাত্রী সামিয়া মারা যান।

ঘটনার পরদিন সামিয়াদের শান্তিবাগের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, বাসাটি তিন কক্ষের। এক কক্ষে মা-বাবা থাকেন। আরেক কক্ষে সামিয়া থাকতেন তাঁর ছোট ভাই সোহাইব জামালকে নিয়ে। তৃতীয় কক্ষটি সাবলেট (আরেকজনকে ভাড়া) দিয়ে পরিবারের ব্যয়ের চাপ সামলানো হতো।

সামিয়ার বাবা জামাল উদ্দিন মিরপুরের একটি কারখানায় কাজ করতেন। সামিয়ার মা হোসনে আরা বাসায় সেলাইয়ের কাজ করেন।

সামিয়ার মা হোসনে আরা তখন প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘বিচার চাই না। শুধু মেয়ের লাশ আমাকে পৌঁছে দিলেই হলো।’

সামিয়া আফনানের লাশের অপেক্ষায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে অপেক্ষারত বাবা জামাল উদ্দিন
ফাইল ছবি

সামিয়ার বাবা জামাল উদ্দিনেরও কথা ছিল সেটাই, ‘কার শাস্তি চাইব? বিচার নাই, বিচার কার কাছে চাইব?’

টিপু ও সামিয়া হত্যার ঘটনায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) গত জুনে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়ে বলেছে, চাঁদাবাজি ও রাজনৈতিক আধিপত্য—এ দুই কারণে টিপুকে হত্যা করা হয়। হত্যার পরিকল্পনায় বিদেশে পলাতক দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদ, জাফর আহমেদ ওরফে মানিকসহ ৩০ জনের নাম এসেছে। আর হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন তিনজন। টিপুকে করা গুলিতেই প্রাণ যায় কলেজছাত্রী সামিয়া।

মামলাটি এখন বিচারাধীন। তবে খুনে জড়িত বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।

ঘামঝরা জীবন রক্তে ভিজে শেষ

আবু বকর ছিদ্দিক। তাঁর মৃত্যুর খবর নিয়ে ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারির প্রথম আলো।


২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলে সিট দখল নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আবু বকর ছিদ্দিক খুন হন।

এ ঘটনায় ২০১৭ সালে আদালতের রায়ে ছাত্রলীগের ১০ নেতা-কর্মী খালাস পেয়েছেন। এ রায়ের কথাও কেউ জানতেন না। রায়ের আট মাস পর যখন রায়ের কথা জানা গেল, তখন উচ্চ আদালতে আপিল করার সময়ও পেরিয়ে গেছে।

আবু বকর ছিদ্দিক টাঙ্গাইলের মধুপুরের গোলাবাড়ী গ্রামের দিনমজুর রুস্তম আলীর ছেলে। দরিদ্র পরিবারের সন্তান আবু বকর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সময় গ্রামে গিয়ে কৃষিখেতে কাজ করতেন, প্রতিবেশীদের বাচ্চাকে পড়িয়ে নিজের পড়ার খরচ জোগাতেন। তিনি ভাইকে বলে এসেছিলেন, আর একটা বছর। তারপর তাঁদের দুঃখ ঘুচবে। তাঁর মৃত্যুতে পুরো পরিবারের স্বপ্ন ভেঙে যায়।

আবু বকর তৃতীয় সেমিস্টার পর্যন্ত সিজিপিএ-৪-এর মধ্যে ৩ দশমিক ৭৫ পেয়েছিলেন। চতুর্থ সেমিস্টারের ফলাফল বের হওয়ার আগে তিনি খুন হন। ওই বিভাগে তাঁর আগে এমন ভালো ফল কেউ করেননি।

আবু বকরের মৃত্যুর পর প্রথম আলোর শিরোনামটি ছিল, ‘ঘামঝরা জীবন রক্তে ভিজে শেষ’।

মারা গেছেন সনির বাবা

সাবেকুন নাহার সনি
ফাইল ছবি।

দুই গ্রুপের বন্দুকযুদ্ধের মধ্যে পড়ে বুয়েট ছাত্রী সাবেকুন নাহার সনির নিহত হওয়ার ঘটনাটি দেশজুড়ে আলোচিত হয়েছিল। ২০০২ সালের ৮ জুন দরপত্র নিয়ে বুয়েট ছাত্রদলের মোকাম্মেল হায়াত খান ওরফে মুকিত এবং এস এম হল ছাত্রদলের মুশফিক উদ্দিন ওরফে টগর গ্রুপের বন্দুকযুদ্ধের মাঝখানে পড়ে কেমিকৌশল বিভাগের ১৯৯৯ ব্যাচের ছাত্রী সাবেকুন নাহার সনি নিহত হন।

সনি হত্যার ঘটনায় হওয়া মামলা নিম্ন আদালতে মুকিত, টগর ও নুরুল ইসলাম সাগর ওরফে শুটার নুরুর মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল। তবে ২০০৬ সালে মৃত্যুদণ্ডাদেশ বাতিল করে হাইকোর্ট তাঁদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত এস এম মাসুম বিল্লাহ ও মাসুমকে খালাস দেন হাইকোর্ট। মামলার প্রধান দুই আসামি মুকিত ও নুরু এখনো পলাতক। আরেক আসামি টগর কারাভোগের পর এখন মুক্ত।

সাবেকুন নাহার সনির বাবা হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া
ছবি: সংগৃহীত।

সনির বাবা হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া গত ১২ ফেব্রুয়ারি ক্যানসারে মারা যান। তিনি মারা যাওয়ার আগে বিভিন্ন সময় মেয়ের হত্যাকারীদের বিচার ও সন্ত্রাসমুক্ত শিক্ষাঙ্গনের দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন।

সনির ২০তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে গত বছর বুয়েট ক্যাম্পাসে সনির স্মৃতিফলকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া বলেছিলেন, ‘কোনো বাবা যেন আর কোনো সনিকে না হারায়।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘বেঁচে থাকা হাজারো সনির জন্য আমাদের সুন্দর পরিবেশ গড়ে তোলার অঙ্গীকার করতে হবে।’

মাদ্রাসাছাত্রের মৃত্যু

মাদ্রাসা ছাত্র রেজাউল করিম
ছবি: সংগৃহীত।

আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ থেকে ফেরার পথে গুলিস্তানে দলটির দুই নেতার অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত হন পথচারী রেজাউল করিম (২১)। তিনি শেরপুরের নকলার বর্গাচাষি আবদুস সাত্তারের বড় ছেলে। ঢাকার যাত্রাবাড়ীর একটি মাদ্রাসায় দাওরায়ে হাদিস বিভাগের ছাত্র ছিলেন রেজাউল।

রেজাউল হত্যা মামলায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করেছিল। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) রাজীব আল মাসুদ প্রথম আলোকে বলেন, হত্যার ঘটনায় দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে তাঁদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই।

সংঘর্ষটি হয়েছিল সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও কেরানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদের অনুসারীদের মধ্যে।

ছেলের মৃত্যুর পর আবদুস সাত্তার বুক চাপড়ে বলছিলেন, ‘আমার বাপের কী দোষ, ও তো কোনো দল করত না।’

রাজধানীর গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের দুই নেতার অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষে ছেলের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর বাবা আবদুস সাত্তারের আহাজারি
ফাইল ছবি

‘সহায়তা করা উচিত’

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আইন পরামর্শক ভুবন চন্দ্র শীলের মৃত্যু হয়েছে দুই সন্ত্রাসী দলের বিরোধের কারণে। রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় ১৮ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার দিকে প্রাইভেট কারের আরোহী শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাঈদ মামুনকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি চালায় একদল সন্ত্রাসী। সেই গুলি লেগেছিল মোটরসাইকেল আরোহী ভুবন চন্দ্র শীলের মাথায়। গত শনিবার তাঁর মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করা হয়। তবে তাঁর অবস্থার উন্নতি হয়নি। পরে গতকাল সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে তিনি মারা যান।

পুলিশের ধারণা, শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাঈদ মামুনকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়েছে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমনের লোকজন। এ ঘটনায় একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে স্বজন হারানো অসহায় পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত। কিন্তু রাজনৈতিক ফায়দা না থাকলে তো সহায়তা দেওয়া হয় না।
শাহদীন মালিক, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

ভুবন চন্দ্র শীলের মৃত্যুর পরে তাঁর পরিবারে উপার্জন করার মতো আর কেউ রইল না।

দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা হয়েছে। কারখানায় শ্রমিক মারা গেলে সহায়তা দিতে শ্রমিক কল্যাণ তহবিল হয়েছে। কিন্তু এলোপাতাড়ি গুলি অথবা দুই পক্ষের সংঘর্ষে মৃত্যুর কোনো ক্ষতিপূরণ নেই।

এ ধরনের ঘটনায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করা যায় কি না, জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ঘটনায় মামলা এখনো হয়নি। তাই বলা দুষ্কর যে কেউ মামলা করলে সফল হবেন কি না। তবে স্বজন হারানো পরিবার ক্ষতিপূরণ চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করে দেখতে পারেন।

আবু বকর সিদ্দিক, সামিয়া আফনান, রেজাউল করিম অথবা ভুবন চন্দ্র শীলের পরিবারের পক্ষে মামলা লড়ার সাধ্য নেই। রাষ্ট্রকেই তাঁদের পরিবারের পাশে সহায়তা নিয়ে দাঁড়ানো উচিত কি না, জানতে চাইলে শাহদীন মালিক বলেন, মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে স্বজন হারানো অসহায় পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত। কিন্তু রাজনৈতিক ফায়দা না থাকলে তো সহায়তা দেওয়া হয় না।