সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় নদী আছে ৫২টি। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন বলছে, এক হাজারের বেশি ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান এসব নদী দখল করে আছে। বিশেষজ্ঞের মতে, নদী রক্ষায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বহীনতার কারণে জেলা দুটি বন্যার কবলে পড়ছে।
সিলেট-সুনামগঞ্জ অঞ্চলে বন্যার প্রবণতা বেড়ে গেছে। এখন জেলা দুটিতে বন্যা পরিস্থিতি চলছে। দুই জেলার প্রায় সাড়ে ১৭ লাখ মানুষ এখন পানিবন্দী।
জেলা দুটির বন্যার কবলে পড়া প্রসঙ্গে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, সিলেট ও সুনামগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবহমান নদীগুলো দখলের কারণে সংকুচিত হয়ে পড়েছে। অপরিকল্পিত বালু ও পাথর উত্তোলনসহ নানা কারণে নদীগুলো ভরাট হয়ে গেছে। নদীর গতিপথ পাল্টেছে। উত্তর থেকে আসা পানি বহন করার ক্ষমতা হারিয়েছে নদীগুলো। এখনকার বন্যার এটাই প্রধান কারণ।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, সিলেট জেলায় নদী আছে ১৬টি। ২০১৯ সালে কমিশন অনুসন্ধান করে দেখেছিল, ৩৩০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এসব নদী দখল করেছে। অন্যদিকে সুনামগঞ্জে নদী আছে ৩৬টি। সে সময় এই জেলায় দখলদারদের তালিকায় ছিল ৬৯৫ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের নাম। সব মিলিয়ে দুটি জেলায় ১ হাজার ২৫ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান এসব নদীর বিভিন্ন জায়গা দখল করেছিল।
পরবর্তী সময়ে দুই জেলার প্রশাসন অভিযান চালিয়ে ৩৩৭ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের দখলদারি উচ্ছেদ করতে সক্ষম হয়েছিল বলে জানায় কমিশন।
তবে অভিযোগ রয়েছে, অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের দখলদারি উচ্ছেদ করা যায়নি। গত দুই-তিন বছরে নতুন করে নদী দখল হয়েছে।
সিলেট ও সুনামগঞ্জের গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলোর মধ্যে আছে সোমেশ্বরী, সুরমা, কুশিয়ারা, খোয়াই। ভারতের মেঘালয়ের বৃষ্টির পানি এসব নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়ে একপর্যায়ে মেঘনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন বলছে, সিলেট শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সুরমা নদীর দুই তীর দখল করে বাড়িঘর তৈরি হয়েছে। এ রকম উদাহরণ আছে অনেক। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ উজানে নদী দখল করেছে। জায়গা ভরাট করে স্থাপনা তৈরি করেছে। নদ-নদীর ওপর অপরিকল্পিতভাবে ব্রিজ, কালভার্ট, স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয়েছে। নদী দখল করে বহু জায়গায় হাটবাজার, দোকানপাট ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান হয়েছে। সুনামগঞ্জে নদীর তীরে অবৈধ বাজার ও শিল্পকারখানা আছে ৪৭টি। এসব বাজার ও শিল্পের যাবতীয় আবর্জনা-বর্জ্য ফেলা হয় নদীতে। এ কারণে নদীতে চর পড়েছে। নদীর নাব্যতা কমেছে।
বৃহত্তর সিলেটের অনেক জায়গায় অপরিকল্পিতভাবে বালু, মাটি ও পাথর উত্তোলন করা হয় বলে কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, এগুলো উত্তোলনের সময় নদীর পাড় কাটা পড়ে, যেখানে-সেখানে মাটির স্তূপ তৈরি হয়। আবার কখনো কখনো নদী খননের মাটি রাখা হয় অপরিকল্পিতভাবে। সিলেট জেলার অনেক নদী মৃতপ্রায়।
‘দায়িত্বহীনতায় বন্যা’
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন বলছে, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি ছাড়াও সাধারণ মানুষ অবৈধভাবে নদী দখল করেন। আইন লঙ্ঘন করে সরকারি প্রতিষ্ঠানও নদী দখল করে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নামও এই তালিকায় দেখা যায়। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড নদ-নদীর জমি ইজারা দেয়। এসবই অপরাধ।
সবাই মিলে এই ‘অপরাধ’ বছরের পর বছর ধরে করে আসছে বলে অভিযোগ করেন নদী রক্ষা আন্দোলনে যুক্ত ব্যক্তিরা।
খোদ জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনই বলছে, নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা ফৌজদারি অপরাধ। কিন্তু নদী রক্ষায় ফৌজদারি আইনের প্রয়োগ হতে দেখা যায় না। এই আইন প্রয়োগের ক্ষমতা আছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের ও জেলা প্রশাসনের। কিন্তু তারা তাদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করে না।
ইউনিয়ন বা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বা স্থানীয় সংসদ সদস্যরাও নদী রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারেন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, নদী দখল করে অবৈধ স্থাপনা গড়ে তোলার সময়ই জনপ্রতিনিধিরা বাধা দিতে পারেন। আবার গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদেও তাঁরা সরকারি প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা করতে পারেন।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘দায়িত্বহীনতার কারণে এই বন্যা। কিন্তু হাল ছাড়লে চলবে না। সবাই মিলে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। আইন প্রয়োগ করে নদীগুলোকে দখলমুক্ত করতে হবে। জুতসই প্রকল্পের মাধ্যমে নদীগুলোর নাব্যতা বাড়াতে হবে। নদীতে পানির প্রবাহ বাড়াতে পারলেই বন্যার ঝুঁকি কমবে।’