আঁখির ক্রাচের ভালোবাসায় কোনো বাধাই, বাধা নয়
আঁখি সিদ্দিকা ছোটেন বাতাসের আগে আগে। এই মধুর চাক কাটতে মৌয়ালদের সঙ্গে নিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করছেন। আবার পরদিন বিকেলেই দেখা যাচ্ছে গ্রামের মোড়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসেছেন খুদে শিশুদের সঙ্গে।
ছয়, সাত বছরের একেকজন এসে বিজ্ঞজনের মতো আঁখিকে পরামর্শ দিচ্ছে কোথায় কোন গাছ লাগালে ভালো হয়। কারও পছন্দ জবা ফুল, কারও চাই ফলের গাছ। আঁখি খুব মনোযোগ দিয়ে সেসব শুনে আবার নোট রাখছেন খাতায়। আঁখি সিদ্দিকার বাড়ি সুন্দরবনে না হলেও ভালোবাসার অধিকারে তিনি এখন খুলনার দাকোপ উপজেলার পশ্চিম ঢাংমারি গ্রামের অনেকের ‘মধু আপা’। তবে এই অর্জনটুকু খুব সহজ নয়। সুন্দরবনের লবণাক্ততা, জোয়ার-ভাটা, শ্বাপদ হিংস্র প্রাণী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এই সবকিছু আঁখিকে মোকাবিলা করতে হয় হুইলচেয়ারে বসে অথবা ক্রাচে ভর দিয়ে।
ছোটবেলায় পোলিও কেড়ে নিয়েছে তাঁর এক পায়ের শক্তি। কিন্তু জীবনবোধ হয় এরই বিনিময়ে তাঁকে উপহার দিয়েছে শতগুণ বেশি মানসিক শক্তির জোর। সে শক্তির উৎস মানুষকে ভালোবাসার আশ্চর্য ক্ষমতা। গত ১৯ মে দুপুরে আঁখি সিদ্দিকার সঙ্গে দেখা ঢাংমারির বানিশান্তা ইউনিয়নে। প্রখর রোদের ভেতর তিনি ক্রাচে ভর দিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছেন। বলছিলেন, জীবনে এত প্রতিকূলতা এসেছে, মানুষকে ভালোবাসা এবং তাঁদের ভালো চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা না থাকলে নিজেই শেষ হয়ে যেতাম।
সবশেষ ঘূর্ণিঝড় রিমালের পর আঁখি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন ‘যে সুন্দরবনের জন্য আপনি রক্ষা পেলেন; সেই সুন্দরবনের মানুষের জন্য আপনি কি কিছু করতে পারেন না?’ ঝড়ের সময় সুন্দরবনে বসে দুর্যোগের ভয়াবহ প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তিনি। এই ঝড়ে ও জলোচ্ছ্বাসে দেশের অন্যান্য উপকূলের মতো দাকোপের পশ্চিম ঢাংমারি প্লাবিত হয়েছে। এমন দুর্যোগের আগাম সতর্কবার্তা পেয়ে কেউ কেউ যখন নিরাপত্তার জন্য মোংলা, বাগেরহাট অথবা খুলনা শহরের দিকে উঠে এসেছিলেন; আঁখি তখন রাজধানী থেকে উল্টো চলে গিয়েছেন সুন্দরবনে। আঁখির ভাষ্যমতে, ‘এই অঞ্চলের মানুষেরাই আমার আপনজন। বিপদের সময় পাশে পেলে ভরসা পাবে।’
সুন্দরবনের শক্ত মাটিতে আঁখির ক্রাচ চলে দ্রুতগতিতে। সামান্য বৃষ্টি পেলে এই মাটি মোমের মতো নরম হয়ে যায়। তখন দুই পা আগানো কতটা কঠিন, তা শুধু যাঁদের অভিজ্ঞতা আছে, তাঁরা জানেন। আঁখি সিদ্দিকা সেই সময়েও নিজের গতি থামান না। কেননা জীবনে বহুবার তাঁর গতি থামিয়ে দিতে হয়েছে। কখনো অসুস্থতায়, কখনো পরিবারের সিদ্ধান্তে। ছোটবেলায় শিশু আঁখি আবিষ্কার করেছিলেন সমবয়সী সব শিশু দুই পায়ে দৌড়ে যায়। তাকে তখন এক পা এক পা করে অতিক্রম করতে হয় সামান্য পথ। তখন আরও বেশি দূরবর্তী হয়ে যেত ক্লাসরুমের ব্ল্যাকবোর্ড, অথবা মাঠের এক পাশে দাঁড়ানো প্রিয় জবা ফুলের গাছটা।
রক্ষণশীল পরিবারের এই মেয়েটির পড়ালেখা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল শৈশবে। বিয়ে দেওয়া হয়েছিল কিশোরী বয়সে। কিন্তু আঁখি যে অপ্রতিরোধ্য তা হয়তো আঁখি নিজেও জানতেন না। তিনি শুধু ভালোবাসতেন চারপাশের সব অসহায় মানুষকে। তাই নিজের পড়ার খরচ জোগাড় করতে যখন কাগজের ঠোঙা বানিয়ে বিক্রি করতে হয়েছে, তখন তিনি পথশিশুদের স্বরবর্ণ শেখাতে শুরু করেছেন স্কুলে।
আঁখি সিদ্দিকার ‘মধু আপা’ হওয়ার পেছনে একটা ঘটনা আছে। দাদন নিয়ে মৌয়ালরা মধু কাটতে বনে যান, কিন্তু ন্যায্যমূল্য পান না। ফলে তাঁদের ক্ষতি আর কোনো দিন পূরণ হয় না বরং ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে। সুন্দরবনের এই এলাকার মৌয়ালদের এই সংকট দেখে আঁখি নিজেই অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে মধ্যস্থতাকারীদের বাদ দিয়ে সরাসরি মধু বিক্রির সুবিধা করে দিলেন। আঁখির দাবি অনুযায়ী, ‘এক ঋতুতে তিনি ৩ লাখ টাকার’ মধু বিক্রি করে দিয়েছেন মৌয়ালদের। ঢাংমারি গ্রামের অনেক মৌয়াল তাঁকে তাই ভালোবেসে ওই নামে ডাকেন।
এই গ্রামের নারীদের হাতের কাজ শিখিয়ে উপার্জনের চেষ্টা করছেন আঁখি। তাঁদের শেখাচ্ছেন গৃহপালিত পশুপাখি পালনের নিয়ম। এভাবে পশ্চিম ঢাংমারির অনেক নারী এখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লবণাক্ত পানিতে পোনা সংগ্রহ থেকে সরে এসেছেন। কেউ কেউ বাড়িতে গবাদিপশু পালন শুরু করেছেন তাঁর আয়োজন করা প্রশিক্ষণ থেকে। তবে আঁখি নিজেই বললেন ‘আমার আগ্রহ দেখে পরিচিত কেউ কেউ এগিয়ে আসে, দু–একটি সংস্থা থেকে সামান্য কিছু সহায়তা পাই, কিন্তু সুন্দরবনের মানুষের এসব সংকট মোকাবিলায় তা এত সামান্য যে সমুদ্রে এক বালতি জলের মতো। তাই আমি গুরুত্ব দিচ্ছি, সহযোগিতা নয়, নিজেদের সংকট মোকাবিলায় তাঁদেরই স্বনির্ভরশীল হওয়ায়।’ এই গ্রামের সীতা মণ্ডল, নমিতা বাছার, সবিতা রায় ‘আঁখি দিদি’ বলতে প্রাণান্ত। তাঁরা শিখছেন হাতের কাজ।
এখানকার নদীর কূলের আরেক নারী পূর্ব ঢাংমারির লতা বিশ্বাস। প্রিয়ন্তি নামের তাঁর একটি চায়ের দোকান আছে। বানিশান্তা বাজার থেকে এই দোকানে হেঁটে যেতে লাগে ১০ মিনিট। লতা বললেন ‘আঁখি দিদির প্রসঙ্গে কোনো কথা বলব আর কোনটা বলব না, তা–ই বুঝতি পারি না। দোকানের মাল তুলতি হলি টাকা লাগবি অথবা গিরামের নাটকে বনবিবি সাজতি আমার শাড়ি চাই। প্রথমেই মনে পড়ে দিদির কথা। সে ঢাকায় থাকলিও ফোন দিয়ে কথা কয়ে জেনে নেই। এই গিরামে মহিলাদের জন্য সে অনেক চেষ্টা করতিছে।’
এই গ্রামের নারীদের সেলাই মেশিন কিনে দিয়ে তাদের কর্মসংস্থানের চেষ্টা করছেন আঁখি। এসব কাজে তাঁকে বেসরকারি কিছু সংস্থা সহায়তা করে। তিনি জানালেন, পদ্ধতিটি সমবায় ভিত্তিতে করা হচ্ছে। যেমন যে পাঁচজনের মেশিন আছে তারা কাজ আনবে, অন্যদের শেখাবে ও তাদের রোজগারের টাকা থেকে কিছু টাকা জমিয়ে বছরে আরেকজনকে আরেকটি মেশিন কিনে দেবে। এ ছাড়া উঠান বৈঠকের মাধ্যমে বাড়িতে বাড়িতে উঠান খামার তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। এলাকায় নারীদের স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিয়ে সচেতনতা তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এই কাজগুলো এমনভাবে করা হচ্ছে যে শিখবে, সে আরেকজনকে শেখাবে। এতে গ্রামের মানুষের মধ্যে সুসম্পর্কও তৈরি হবে।
ঢাংমারি খালের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আঁখি বললেন, ‘গ্রীন ভয়েস’ নামে একটি সংগঠনের সহযোগিতা নিয়ে সুন্দরবনে ‘সবুজ পাঠশালা’ নামে স্কুল তৈরি করেছেন। এই গ্রামের শিশুরা পাঠ নিচ্ছে, বইয়ের অক্ষরের পাশাপাশি ওরা চিনছে প্রকৃতি। সুন্দরবনঘেঁষা এই জনপদের শিশুরা এখন পয়লা বৈশাখ, পয়লা ফাল্গুন পালন করে আড়ম্বরে।
পূর্ব ঢাংমারির সেন্ট জোসেফ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন নিবাশ হালদার। ঘূর্ণিঝড় রিমালের সময় পশুর নদী টেনে নিয়েছে তাঁর বসতঘর। নিবাশ হালদারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল গত ১৯ মে পশ্চিম ঢাংমারিতে। ঝড়ের পর আবার কথা হলো মুঠোফোনে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আঁখি সিদ্দিকা মৌয়ালদের মশাল নিভানোর প্রশিক্ষণ দেয়, সামাজিক মূল্যায়ন শেখায়। গ্রামের নারীদের দিয়ে হস্তশিল্প তৈরি করে স্যুভেনির হিসেবে বিক্রির চেষ্টা করছেন। ফলে কেউ কেউ এখন নদীতে নেমে পোনা সংগ্রহ বাদ দিয়েছে। আঁখি দিদি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি করেছেন, তা হলো এখানকার মানুষকে স্বপ্ন দেখতে শেখাচ্ছেন।’
আঁখি সুন্দরবনে প্রথমে যান ২০১৫ সালে গবেষণার কাজে। এর পর থেকে নানাভাবে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছেন সুন্দরবনের সঙ্গে। বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে মৌয়ালদের সঙ্গে সুন্দরবনে ঢোকেন আঁখি। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের মালিকানাধীন বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ‘ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ’ (আইসিবি)–এ প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সুন্দরবনের কাছাকাছি থাকতে চেয়েছিলেন বলে ২০১৫ সালে বদলি হয়ে ৫ বছর ছিলেন খুলনায়। বর্তমানে তাঁর কর্মস্থল ঢাকায়। তাঁর একমাত্র সন্তান ‘অরুণিত ভোর’ এখন ভারতের দিল্লিতে পড়াশোনা করে।
মুন্সিগঞ্জে জন্ম ও বেড়ে ওঠা আঁখির। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়েছিল পরিবারের পছন্দে। সে সংসারটি ছিল মাত্র দুই বছরের। এরপর এক যুগেরও বেশি সময় পর নতুন করে গাঁটছড়া বেঁধেছেন কামাল খানের সঙ্গে। ঢাংমারি খালের পাশে সুন্দরবন ঘেঁষে স্থানীয় বনজীবীদের বিশ্বাসের প্রতি সম্মান জানিয়ে আঁখি আর তাঁর স্বামী মিলে তৈরি করে দিয়েছেন বন বিবির থান। এখানে বসে বন বিবির পুঁথিপাঠের আসর। আঁখি প্রথম আলোকে বললেন, ‘কোনো জনপদের মানুষের কাছ থেকে ভালোবাসা পেতে হলে তাদের বিশ্বাসকেও সম্মান করা জরুরি। আমি বিশ্বাস করি মানুষ এবং প্রকৃতি যেকোনোভাবেই হোক ভালোবাসার প্রতিদান দেয়। তাই ক্রাচ টেনে টেনে এই বনের মাটি, জংলা অতিক্রম করতে আমার কষ্ট হয় না। বরং পথে পথে ভালোবাসা কুড়িয়ে আরও শক্তি পাই চলার।’