খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন উম্মে সালমা যোহরা। প্রথম দিনেই বুঝেছিলেন, তিনিই বিভাগের একমাত্র নারী শিক্ষার্থী। তাঁর কাছে অস্বস্তিকর ছিল বিষয়টি। বিভাগ পরিবর্তন করবেন কি না, সে চিন্তাও মাথায় এসেছিল। পুরোনো সেই কথা শুনে এখন উম্মে সালমার শিক্ষার্থীরা অবাক চোখে তাকায়। তাঁর ছেলে–মেয়েরাও এ নিয়ে গর্ব করে।
১৯৯৫ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বিএসসি ইন বায়োটেকনোলজি’ প্রোগ্রাম চালুর মধ্য দিয়ে বায়োটেকনোলজি বিষয়ে শিক্ষার যাত্রা শুরু হয়। সে বছরই উম্মে সালমার বাবা কৃষিবিদ এম এ আহাদ খান তাঁকে এই প্রোগ্রামে পড়ার উৎসাহ দিয়েছিলেন। সেখানে পড়া শেষে বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে ২০১২ সাল থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে শিক্ষকতা শুরু করেন উম্মে সালমা।
উম্মে সালমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন চালু হওয়া বিভাগের ১৭ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে আমিই ছিলাম একমাত্র মেয়ে। প্রথমে বিব্রতকর মনে হলেও পরে সহপাঠীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে যায়।’ একজন সহপাঠীর সঙ্গে বন্ধুত্বটা একটু বেশি হয়েছিল। ২০০১ সালে বিভাগের সহপাঠী মোহাম্মদ শাহেদুর রহমানকে বিয়ে করেন উম্মে সালমা। দুজনই এখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক। একমাত্র ছেলে শাদমান রহমান এই বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়াশোনা করছেন। এক মেয়ে সারাহ রহমান পড়ছে অষ্টম শ্রেণিতে।
উম্মে সালমার জন্ম মেহেরপুরে। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি। বাবা কৃষিবিদ ছিলেন এবং বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনে (বিএডিসি) চাকরি করতেন। আর মা রাজিয়া খান গৃহিণী। তাঁরা থাকেন যশোরে। বাবার চাকরিতে তিন বছর পরপর বদলির কারণে দেশের বিভিন্ন জায়গায় থেকেছেন উম্মে সালমা। ১৯৯২ সালে রাজশাহীর হেলেনাবাদ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৯৪ সালে যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি।
জীববিজ্ঞানের একটি অত্যাধুনিক শাখা হলো বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং। এটি একটি ‘মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি’ বিষয়। উম্মে সালমা বলেন, এটি বায়োকেমিস্ট্রি, মলিকুলার বায়োলজি, মাইক্রোবায়োলজি, ইমিউনোলজি ও জেনেটিকস ইত্যাদি বিষয়ের একটি সমন্বিত রূপ। এর আওতায় অ্যানিমেল সেল কালচার, প্ল্যান্ট টিস্যু কালচার, ডিএনএ ফিঙ্গার প্রিন্টিং, রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ টেকনোলজি, জিন থেরাপি, জেনোম সিকুয়েন্সিং, ডেভেলপমেন্ট বায়োলজি, স্টেম সেল থেরাপি, ক্যানসার বায়োলজি, রিজেনারেটিভ মেডিসিন, ন্যানোটেকনোলজি, ড্রাগ ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, ভ্যাকসিন ডেভেলপমেন্ট ইত্যাদি জটিল বিষয় পড়ানো হয়। অন্যান্য বিশেষায়িত প্রযুক্তি সম্পর্কেও পড়ানো হয়।
২০০০ সালে উম্মে সালমা বিএসসি সম্পন্ন করেন। ২০০১ সালে টোকিও ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে ‘মনবুকাগাকুশো’ বৃত্তি পান। ওই বছরের নারী দিবসে বিয়ে করেছিলেন তিনি। বিয়ের পর স্বামীকেও মনবুকাগাকুশো বৃত্তির জন্য নির্বাচিত করে জাপান দূতাবাস। কিন্তু সে সময় জাপান সরকার একটি পরিবারে একজনকেই বৃত্তি দিত। তাই উম্মে সালমা তাঁর বৃত্তি বাতিল করে স্পাউস ভিসায় জাপানে যান। ২০০২ সালে তাঁর ছেলের জন্ম হয়। ছেলেকে দেখাশোনা করার পাশাপাশি পড়াশোনার প্রস্তুতি নিতে থাকেন উম্মে সালমা। ২০০৪ সালে নিজ খরচে এমএস শুরু করেন।
২০০০ সালে উম্মে সালমা বিএসসি সম্পন্ন করেন। ২০০১ সালে টোকিও ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে ‘মনবুকাগাকুসো’ বৃত্তি পান। ওই বছরের নারী দিবসে বিয়ে করেছিলেন তিনি।
উম্মে সালমা স্নাতকোত্তরে অ্যাটোমিক ফোর্স মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করে সিঙ্গেল সেল ম্যানুপুলেশনের কাজ করতেন। মাইক্রোস্কোপকে শুধু ভিজ্যুয়াল অবজারভেশনের জন্য ব্যবহার না করে সেটাকে জিন ট্রান্সফরমেশনের বা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একটা টুল হিসেবে কীভাবে ব্যবহার করা যায়, তা নিয়েই ছিল উম্মে সালমার কাজ। তিনি এ কাজে সফল হন এবং ২০০৬ সালে এমএস সম্পন্ন করেন।
একই বছর পিএইচডির জন্য এনভায়রনমেন্টাল কেমিস্ট্রি অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে যোগ দেন উম্মে সালমা এবং জাপান সরকারের ইন্টারনাল মনবুকাগাকুশো বৃত্তি পান। গবেষণায় বায়োফিল্ম ফার্মেন্টেশন পদ্ধতিতে লিপোপেপটাইড অ্যান্টিবায়োটিক তৈরির কাজ করেন, যা পরবর্তী সময়ে সিড কোটিং প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত হয়। উম্মে সালমা বিভিন্ন ফসলের ওপর বায়োফিল্ম সিড কোটিংয়ের ভূমিকা পর্যবেক্ষণ করতেন। ২০০৯ সালে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। একই বছর জাপানের আনিসে করপোরেশনে গবেষক হিসেবে যোগ দেন।
২০১০ সালে পারিবারিক কারণে দেশে ফেরেন উম্মে সালমা। ২০১১ সালে মেয়ের জন্ম হয়। ২০১২ সালে শিক্ষকতা শুরু করেন। বিভাগে শিক্ষকতা ও গবেষণার পাশাপাশি ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করছেন তিনি।
উম্মে সালমা বলেন, প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ভ্যাকসিনসহ বায়োটেকনোলজিতে বেশ ভালো অবস্থানে আছে। কিন্তু প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে। তাই দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে কোলাবোরেশনের (সহযোগিতা) মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়ন, অবকাঠামো বৃদ্ধি এবং দীর্ঘমেয়াদি টেকসই বায়োটেক প্ল্যাটফর্ম তৈরির স্বপ্ন দেখেন তিনি। উম্মে সালমা বলেন, জাতীয় ও বৈশ্বিক নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ সহজে মোকাবিলায় এটা জরুরি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ছেলে ও মেয়ে শিক্ষার্থী সমান সমান। উম্মে সালমা বলেন, তিনি তেমন কিছু না জেনেই এই বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। তবে বর্তমানে শিক্ষার্থীরা সম্ভাবনার কথা জেনেই স্বপ্নপূরণে ভর্তি হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত এই বিভাগগুলোর প্রতি নজর দেওয়া। কারণ, এখানে ব্যবহারিক ক্লাসগুলো করানো খুব জরুরি এবং বেশ ব্যয়বহুল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার জন্য বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। ভালো গবেষণার সুযোগ থাকলে শিক্ষার্থীরা অনেক কিছু শিখতে পারবে এবং তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে কাজে লাগাতে পারবে।
উম্মে সালমা বলেন, নারী হিসেবে তাঁকে সংসার ও ক্যারিয়ার—দুই দিকই সামলাতে হয়েছে। তাই পথচলা কখনোই একেবারে সহজ ছিল না।
উম্মে সালমা বলেন, নারী হিসেবে তাঁকে সংসার ও ক্যারিয়ার—দুই দিকই সামলাতে হয়েছে। তাই পথচলা কখনোই একেবারে সহজ ছিল না। বলা যায়, পরিবারের সহায়তা এবং জাপানে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের সহায়তা পাওয়ায় পথটা একটু সহজ হয়েছিল। তিনি ভ্যাকসিন নিয়ে ভবিষ্যতে কাজ করতে চান।
উম্মে সালমা বললেন, করোনার ভ্যাকসিন তৈরি, ভাতের মধ্যে ভিটামিন এ ক্যাপসুল মেশানো বা গোল্ডেন রাইস, কৃষি এনজাইম, প্রিজারভেটিভ, কৃষি, মেডিসিন—এমনকি দই বানাতেও বায়োটেকনোলজি বিষয়টি লাগছে। জিন থেরাপি, নিঃসন্তান দম্পতিদের আইভিএফ পদ্ধতিতে সন্তানের জন্ম দেওয়া—সবকিছুতেই এ বিষয়টি জড়িত। বিভিন্ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ফরেনসিক বিভাগ, বায়োটেকনোলজি বেইজড ইন্ডাস্ট্রি, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রি, এনজিও, ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিসহ নানা জায়গায় বায়োটেকনোলজি গ্র্যাজুয়েটদের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি বিদেশে নানা সুযোগ তো আছেই।