দুর্গাপুরে বসে দূরদেশের কাজ করে স্বাবলম্বী সাবানা

ইন্টারনেট বিষয়ে খুঁটিনাটি জানতে ও শিখতে উঠান বৈঠকে এসেছিলেন সাবানা সুলতানা, জিতেছেন পুরস্কার। রাজশাহী দুর্গাপুর উপজেলার দেলুয়াবাড়ি ইউনিয়নছবি: প্রথম আলো

লড়াইটা শুরু হয়েছিল বাবাকে বাঁচানোর। সে লড়াইয়ে জিততে পারেননি সাবানা সুলতানা। তবে কলকাতা থেকে একা বাবার লাশ নিয়ে বাড়ি ফেরার মতো দুঃসাহস দেখাতে পেরেছিলেন। এই সাহসকে তিনি শক্তিতে পরিণত করেন। কোভিড মহামারির সময়ে সবাই যখন নিজের জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত, সাবানা তখন ঘুরে দাঁড়ানোর পথ খোঁজেন। প্রশিক্ষণ নিয়ে অনলাইনে ডাটা এন্ট্রির কাজ শুরু করেন। তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। পড়াশোনা শেষ করে হয়েছেন স্বাবলম্বী, ধরেছেন সংসারের হাল। রাজশাহী জেলার দুর্গাপুর উপজেলা নিভৃত গ্রাম শ্রীধরপুরে বসেই করছেন দূরদেশের কাজ। বর্তমানে মাসে আয় করছেন ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা।

মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছেন সাবানা। রাজশাহী কলেজ থেকে ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেন তিনি। তাঁর বাবা কৃষিকাজ করতেন। ২০১৮ সালে সাবানার বাবা ক্যানসারে আক্রান্ত হন। যদিও প্রথমে তাঁরা ক্যানসারের বিষয়টি জানতে পারেননি। রাজশাহীতে চিকিৎসকদের দেখানোর পরে তিনি বাবাকে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে আসেন। সেখানে ১৫ দিন সিসিইউতে রাখা হয়। হাসপাতাল যক্ষ্মার চিকিৎসা দেয়। ওই হাসপাতালের খরচ মেটাতেই তারা প্রায় নিঃস্ব হয়ে যান। কিন্তু বাবা সুস্থ হলেন না। বাধ্য হয়ে রাজশাহীতে ফিরে আসেন সাবানা। রাজশাহীতে একটি বেসরকারি রোগ নির্ণয় কেন্দ্রের চিকিৎসক প্রথমে বললেন যে তাঁর বাবার ক্যানসার হয়েছে। শেষ পর্যায়ে রয়েছে। একদিকে বাবার ভুল চিকিৎসা, অন্যদিকে আর্থিকভাবে নিঃস্ব হয়ে দিশেহারা হয়ে যান সাবানা। কিন্তু হাল ছাড়েননি। তিনি একাই বাবাকে নিয়ে কলকাতায় যান। সেখানে হাসপাতালে ১৫ দিন চিকিৎসা দেওয়ার পরও বাবাকে বাঁচানো যায়নি।

সাবানা সুলতানা, সঙ্গে ল্যাপটপ আর ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেই যেকোনো স্থান থেকে করতে পারেন ডাটা এন্ট্রির কাজ
ছবি: প্রথম আলো

কলকাতা থেকে ফিরলেন। নগদ টাকা-পয়সা সব শেষ। জমিগুলোও বন্ধক দেওয়া ছিল। কোনো উপায় না দেখে সাবানা রাজশাহীতে এসে কোচিং সেন্টারে ক্লাস নেওয়া ও টিউশনি শুরু করেন। কিন্তু করোনার মধ্যে সব বন্ধ হয়ে গেল। তিনি রাজশাহী কলেজের মেয়েদের হোস্টেলে থাকতেন।  হোস্টেলও বন্ধ হয়ে গেল। এ সময় রাজশাহী কলেজের এক জুনিয়র তাঁকে অনলাইনে কাজের সন্ধান দেন। ডাটা এন্ট্রি করা। এ জন্য প্রথমে সাবানাকে প্রশিক্ষণ নিতে হয়। তারপর রাজশাহী শহরে একটি ঘরভাড়া নিয়ে তিনি এ কাজ শুরু করেন। তাঁকে আমেরিকা, ফ্রান্স, রাশিয়া, জার্মানিসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ‘পারিবারিক তথ্য’ অনলাইনে ইনপুট দিতে হয়। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের সময় রাশিয়ার কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যদিও এখন আবার পাচ্ছেন। ফরমায়েসগুলো নিজ নিজ দেশের ভাষায় হাতে লেখা অবস্থায় আসে। সেগুলোকে সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষায় কম্পিউটারে টাইপ করে ইনপুট দিতে হয়। এর মধ্যে ফ্রান্সের কাজের সবচেয়ে ভালো পারিশ্রমিক পাওয়া যায়।

দৈনন্দিন জীবনে ইন্টারনেটের ব্যবহার ও সম্ভাবনা সম্পর্কে শিখছেন উঠান বৈঠকে আসা গ্রামীণ নারীরা। রাজশাহী দুর্গাপুর উপজেলার দেলুয়াবাড়ি ইউনিয়ন
ছবি: প্রথম আলো

মজার ব্যাপার হলো, এই কাজ করতে গিয়ে সাবানাকে বিভিন্ন দেশের বর্ণমালা চিনতে এবং লেখা শিখতে হয়েছে। এখন তিনি স্বাচ্ছন্দ্যে প্রায় যেকোনো দেশের হাতের লেখা দেখে কম্পিউটারে টাইপ করতে পারেন। সাবানা বলেন, ‘২০২০ সালের জুলাই থেকে আমি অনলাইনে ডাটা এন্ট্রির কাজ শুরু করি। থামিনি। এখন পর্যন্ত এ কাজটিই করে যাচ্ছি। এখন আর আমাকে রাজশাহী শহরে থাকতে হচ্ছে না। সঙ্গে ল্যাপটপ থাকলেই যেকোনো জায়গায় বসে কাজ করতে পারছি। শুধু দরকার ইন্টারনেট সংযোগ। এখন আমার প্রতি মাসে ২০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা আয় হয়।’

সাবানা এখন গোল্ডেন হারভেস্ট ইনফোটেক লিমিটেড নামের একটি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের ‘অনলাইন অপারেটর’ পদে কাজ করছেন। গত ২১ সেপ্টেম্বর দুর্গাপুর উপজেলার দেলুয়াবাড়ি ইউনিয়নে অনুষ্ঠিত উঠান বৈঠকে দেখা হয় সাবানা সুলতানার সঙ্গে। এ আয়োজন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এখানে এসে আমার খুবই ভালো লেগেছে। পিছিয়ে পড়া গ্রামীণ নারীদের জন্য এটি খুবই অনুপ্রেরণামূলক আয়োজন।’

সাবানার মতো অসংখ্য গ্রামীণ নারীর বিভিন্ন ক্ষুদ্র উদ্যোগ শুরু করতে সাহস ও উৎসাহ জোগানো এই প্রচারাভিযানটির নাম ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’। ইন্টারনেটের বহুমুখী ব্যবহার শেখার মাধ্যমে গ্রামীণ নারীরা যাতে জীবনের চলার পথের ছোটখাটো সমস্যার সমাধান নিজেরাই করতে পারেন, সেটাই এই আয়োজনের লক্ষ্য। গ্রামীণফোনের এই উদ্যোগটির মাধ্যমে সারা দেশের দুই হাজার ইউনিয়নে চলছে উঠান বৈঠক। সহযোগিতায় রয়েছে প্রথম আলো, নকিয়া ও ঢাকা ব্যাংক। গতকাল রোববার (২০ অক্টোবর) পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন বিভাগের ১ হাজার ৩৮১টি ইউনিয়নে উঠান বৈঠক সম্পন্ন হয়েছে।