মার্জিয়ার বাড়ি ফেরার আকুলতা
রানার ছুটছে তাই ঝুম্ঝুম্ ঘণ্টা বাজছে রাতে
রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে,
রানার চলেছে, রানার! ...
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের যুগে রানাররা ছুটে চলতেন খবরের বোঝা হাতে। এই সময়ে হলে কবি হয়তো লিখতেন ‘খাবারের বোঝা’ হাতে রানারের ছুটে চলার কথা। কারণ এ যুগের ‘রানাররা’ তো জানা-অজানা নানা খাবারের প্যাকেট কাঁধে নিয়ে ছুটে চলেন!
নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, এ যুগের ‘রানার’ কারা? জি, খাবার ডেলিভারিম্যানদের কথাই বলা হচ্ছে। ডেলিভারিম্যান, নাম দিয়ে অনেকেই বোঝেন এটা পুরুষের নির্ধারিত কাজ! কিন্তু আমরা আজ বলব, একজন ‘ডেলিভারিওম্যানে’র কথা। তাঁর নাম মার্জিয়া আক্তার।
‘এটা তো ছেলেদের কাজ। একজন মেয়ে হয়ে এ কাজ তুমি কীভাবে করছ? কী বিশ্রী বিষয়…। প্রায়ই এমন কটুবাক্য শুনে পথ চলতে হয় আমাকে।’ স্পষ্ট আক্ষেপ মার্জিয়া আক্তারের কণ্ঠে। তিনি বলেন, ‘জীবিকার সন্ধানে আমি আসলে বুঝতে পারছিলাম না কী করব। প্রতিবেশী এক ভাইয়ের দিকনির্দেশনায় আমি এ পেশায় এসেছি। পরিশ্রম করছি। উপার্জন করছি। আমি তো চুরি করছি না। একজন মেয়ে এই পেশায় এসেছে, আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে সেটাকে বাঁকা চোখে দেখা হচ্ছে। কিন্তু আমি জানি, এ পেশায়ও দিন দিন নারীরা তাঁদের সক্ষমতা ও সফলতার প্রমাণ রাখবেন।’
মুদ্রার উল্টো পিঠও আছে। অনেক বাসায় খাবার ডেলিভারির সময় সুশিক্ষিত-মার্জিত মানুষের দেখাও পান মার্জিয়া। তাঁরা তাঁকে অভিবাদন জানান। দোয়া করেন। তাঁর পরিশ্রমকে সম্মান জানান।
কীভাবে এ পেশায় আসা? মার্জিয়া আক্তার বলেন, ‘আমার বাড়ি সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ। বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে ছিলাম। সংসারে টানাটানি থাকলেও সুখেই ছিলাম। আমার বিয়ের কিছুদিন পর অসুস্থ হয়ে যাই। এরপর জানতে পারি, আমি কখনো মা হতে পারব না। এ নিয়ে স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্য এবং দূরত্ব বাড়তে থাকে। একটা সময় বিবাহবিচ্ছেদ হয়।’
স্মৃতিচারণা করতে করতে ভারী হয়ে ওঠে মার্জিয়ার কণ্ঠ, ‘এর মধ্যে আমার মা মারা যান। বাবা আর আমি দিশাহারা। বাবাও অসুস্থ। কীভাবে দুজন মানুষের খাবার জোগাড় করব, সেই চিন্তায় দিশাহারা হয়ে পড়ি। তারপর এক আত্মীয়ের কাছে বাবার দায়িত্ব দিয়ে আমি পাড়ি জমাই ঢাকায়। যাত্রাবাড়ীতে থাকি। পুরান ঢাকা এলাকায় খাবার ডেলিভারির কাজ নিই। যা আয় হয়, আমার নিজের খরচ চলে যায়। বাবাকেও পাঠাই।’
ঢাকায় এক কক্ষের আবাস মার্জিয়ার। গ্রামে যাওয়া হয় খুব কম। বাড়িতে তাঁর বাবা কোনোরকমে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছেন, কষ্টে-সৃষ্টে থাকেন। সেখানে গিয়ে থাকার জায়গা নেই দেখে বাড়িতেও খুব কম যান মার্জিয়া। তবে প্রতিদিন ফোনে বাবার সঙ্গে কথা হয়। মাঝে মাঝে আত্মীয়দের ফোনে ভিডিও কলে বাবাকে দেখেন। অসুস্থ বাবাও ফোনেই মেয়েকে দেখে মনের আকুলতা মেটান। মার্জিয়ার এখন একটাই স্বপ্ন, টাকা জমিয়ে বাড়িতে কোনোরকম একটা ঘর করা। যেন তাঁর বাবাকে আর কষ্ট করতে না হয়। তিনিও যেন শিকড়ের টানে বাড়ি যেতে পারেন। বাবার বুড়িয়ে যাওয়া হাতটা নিজের মাথায় ছোঁয়াতে পারেন। ছোট ছোট এই স্বপ্নগুলোই মার্জিয়াকে এগিয়ে যেতে প্রেরণা জোগায়। সাইকেলের প্যাডেল আরও জোরে ঘোরান তিনি। ছুটে চলেন কাঁধে খাবারের বোঝা নিয়ে।
পবিত্র ঈদুল ফিতর সমাগত। ঈদের সময়টা কেমন কাটে মার্জিয়ার? ‘ছোটবেলার ঈদ তো চমৎকার ছিল। সেগুলোর কথা এখন ভাবলেও অনেক আনন্দ হয়। মা ছিলেন। মায়ের হাতের রান্না আর ঈদের বেড়ানো—সবই ছিল। এখন মা নেই। ঈদ মলিন হয়ে গেছে। বাড়ি গেলে বাবার আর আমার কোনোরকমে ঈদের দিনগুলো কেটে যায়। অসুস্থ বাবা শুধু আমার মায়ের স্মৃতিচারণাই করেন।’
বলতে বলতে চোখের পানি মোছেন মার্জিয়া, ‘কয়েক বছর যাবৎ বাড়ি যাওয়া হচ্ছে না। ঈদের দিনও ঢাকায় থাকি। কাজ করি। নাড়ির টান খুব অনুভব করি। মা বেঁচে থাকলে হয়তো যেভাবেই হোক বাড়ি যেতাম। ঈদের সময় গাড়ি ভাড়া বেশি, ভিড়ও থাকে। কিন্তু বাবার মুখটা খুব মনে ভাসে। এই বয়সে একা একা ঈদ করবেন। কোনোরকম একটা ঘর বানাতে পারলে বাবাকে আর তাঁর মেয়ের জন্য এমন তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করতে হবে না। তবে ঈদ করতে এবার আমি বাড়িই যাব। যত কষ্টই হোক।’
মার্জিয়া ঘর বানানোর স্বপ্ন দেখেন। নিজের ছোট্ট একটা ঘর। সেই ঘরে বাবাকে নিয়ে পরিবারের হারিয়ে যাওয়া ঈদের দিনের আনন্দটুকু ফিরিয়ে আনবেন—এই স্বপ্নেই বেঁচে আছেন তিনি। তাঁর মতো বাড়ি ফেরার এই আকুলতা সবার। সবার ভিন্ন ভিন্ন স্বপ্নগুলো বাড়ি ফিরে আসুক, সবার ঈদ আনন্দের হোক। এই চাওয়াটা মার্জিয়া আক্তারেরও।