মানুষকে তাঁরা মুক্তিকামী করতে চেয়েছিলেন

সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ

আর দুই দিন পরই বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিজয়ের দিন ১৬ ডিসেম্বর। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্ব থেকে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৪ সালের হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের বিজয় ও পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষা, ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন, ১৯৬৬-এর ৬ দফা ঘোষণা, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের রক্তাক্ত সিঁড়ি বেয়েই আমরা পৌঁছেছিলাম ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনে। ১৯৭১ সালের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ছিল এরই চূড়ান্ত পর্ব।

বিশ্বের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নানা মাত্রা ও বিবেচনায় অনন্য। প্রকৃতপক্ষেই এটা ছিল একটা জনযুদ্ধ, যাতে গুটিকয় অন্ধ পাকিস্তান-ভক্ত ছাড়া এ দেশের সব মানুষ অংশ নিয়েছিল—কেউ অস্ত্র হাতে, কেউ কোনো না কোনোভাবে তাঁদের সহযোগিতা করে। তাঁদের নেতৃত্বের একটা অংশ পাকিস্তান আন্দোলনেরও নেতা বা কর্মী ছিলেন। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা তাঁদের দ্বিতীয়বারের মতো দীর্ঘ সংগ্রামের যাত্রী করেছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠ কিংবা সৈয়দ নজরুল-তাজউদ্দীন-ওসমানীর নেতৃত্বে প্রবাসী সরকারের যুদ্ধ পরিচালনা এই পথচলারই অবিচ্ছেদ্য অংশ।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে লাখ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছিলেন। ছাত্র ও চাকরিজীবীর রক্তের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল কৃষক ও শ্রমিকের রক্ত। তৎকালীন বাঙালি সেনা, ইপিআর, পুলিশের সঙ্গে জনতার রক্ত। এত রক্ত দিয়ে স্বাধীনতার মূল্য শোধ করতে হয়েছিল; কারণ, বাঙালি জাতিকে লড়াই করতে হয়েছিল একটি সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে—বিশ্বের দুই পরাশক্তি তাদের সর্বাত্মক সমর্থন দিয়েছিল। তখন গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পদদলনের বাস্তবতা অনেকেই ভুলে গিয়েছিলেন!

২৫ মার্চের কালরাত থেকে বিজয় অর্জন পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের একটা প্রধান লক্ষ্য ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বিশেষত, বিশ্ববিদ্যালয় ও সংবাদপত্র। ছাত্র-তরুণদের সঙ্গে শিক্ষক ও সাংবাদিকেরা হানাদার বাহিনীর বিশেষ লক্ষ্যে পরিণত হয়েছিলেন। শত্রুরা জানত, তরুণেরা আনতে পারে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আর শিক্ষক-সাংবাদিকের মতো পেশাজীবীরা থাকেন তাঁদের পেছনে।

শিক্ষা ও তথ্য মানুষের দৃষ্টিকে সম্মুখে অবারিত করে, তখন তারা অন্যায় ও অত্যাচারের স্বরূপ দেখতে পায় এবং এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের মানুষ আট দশক ধরে বারবার এই দৃশ্য দেখেছে।

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে শিক্ষক, সাংবাদিকসহ পেশাজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল রক্তাক্ত বাংলায়। তাই এই দিনটিকে পালন করা হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস রূপে। তাতে স্মরণ করা হয় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শহীদ সব বুদ্ধিজীবীকে। অনেকে এই হত্যার দায় নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াতে চান। কিন্তু পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা রাও ফরমান আলীর ডায়েরিসহ পাকিস্তানি জেনারেলদের স্বীকারোক্তিতেই স্পষ্ট, কারা এই হত্যাকারী।

এই বুদ্ধিজীবীদের অপরাধ ছিল তাঁরা পূর্ব বাংলার ওপর পাকিস্তানি বঞ্চনার ইতিবৃত্ত তৈরি করেছিলেন। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। শহীদুল্লা কায়সার বা সিরাজুদ্দীন হোসেনের মতো সাংবাদিক, মুনীর চৌধুরী বা জি সি দেবের মতো শিক্ষক একটি সুখী-সুন্দর দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁরা চেয়েছিলেন স্বাধীনভাবে বাঁচা যায়—এমন একটি দেশ, যেখানে সবাই মুক্ত পরিবেশে জীবন যাপন করতে পারবে। মানুষের মধ্যে, সমাজের মধ্যে, রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো ধরনের বৈষম্য তাঁদের কাম্য ছিল না। তাঁরা কোনো সুবিধা লাভের জন্য এই লড়াইয়ে অংশ নেননি। বুদ্ধিকে আড়ষ্টতামুক্ত করে জ্ঞানচক্ষু খুলে দিয়ে তাঁরা মানুষকে যুক্তিবাদী ও মুক্তিকামী করতে চেয়েছিলেন। শাসকচক্র সব সময় সত্যকে ভয় পায় এবং সত্যের কণ্ঠ রোধ করতে চায়। এই বুদ্ধিজীবী হত্যা তার আরেকটি নিষ্ঠুর দলিল।

সম্প্রতি বিজয়ী জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার স্বপ্নও একটি বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্বপ্নের সঙ্গে এই স্বপ্নও অবিভাজ্য। এই স্বপ্ন মানুষে মানুষে সমাজের মধ্যে বৈষম্য নিশ্চিহ্ন করার স্বপ্ন, একটি দুর্নীতিমুক্ত দেশের স্বপ্ন, যেখানে সবাই নির্ভয়ে নিজ নিজ মত প্রকাশ করবে, সহিষ্ণুতা নিয়ে অন্যের মত শুনবে ও তাকে অশ্রদ্ধা করবে না, যার যার ধর্ম পালন করবে আনন্দের সঙ্গে, বিশ্বাস বা আদর্শের জন্য কেউ নিগ্রহের শিকার হবে না। অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ বা ভয়ের সংস্কৃতি যে কল্যাণ বয়ে আনে না, তা আবারও মানুষ দেখল। ১৯৫২ সালের ভাষাশহীদ থেকে সাম্প্রতিক জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদ—সবাই ওপার থেকে কান পেতে আছেন, তাঁদের স্বপ্নের বাংলাদেশের আনন্দধ্বনি কবে এই আকাশ-বাতাসে ধ্বনিত হবে।

  • সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ: লেখক; উপাচার্য, রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা