ড. আকবর আলি খানের চলে যাওয়ায় দেশের নাগরিক ও সুধী সমাজে একটি বড় শূন্যতা তৈরি হলো। তিনি এমন একজন বিরল দৃষ্টান্তের কীর্তিমান ব্যক্তি, যিনি নানা সময়ে নানা পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন এবং সব ক্ষেত্রেই অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছেন। কর্মজীবনের বেশির ভাগ সময় সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদের দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছেন; কিন্তু শুধু সে পরিচয়ে তিনি আবদ্ধ থাকেননি। তাঁর মনীষা, বিবেকবোধ ও লেখনী তাঁকে পেশাগত মর্যাদা ও জ্ঞানমনস্কতার অনেক উচ্চস্তরে পৌঁছে দিয়েছে।
আকবর আলি খানকে প্রথম জেনেছি ১৯৬৫ সালে, আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। তিনি তখন সদ্য ইতিহাস বিভাগের প্রবাদতুল্য মেধাবী ছাত্র হিসেবে রেকর্ড নম্বরসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে বেরিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে তিনি কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে গবেষণা করে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। এই শিক্ষা ও গবেষণা তাঁকে একজন ইতিহাসের অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ও সমাজসচেতন অর্থনীতিবিদ হতে সাহায্য করেছে, যা তিনি তাঁর কর্মজীবনের সব ক্ষেত্রে সফলভাবে প্রয়োগ করেছেন।
আমার কাছে তাঁকে সফল সরকারি আমলার পরিচয় থেকেও একজন পড়ালেখা ও জ্ঞানের জগতের মানুষ বলেই বেশি মনে হয়েছে। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে আমি যখন অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলাম, সৌভাগ্যক্রমে তাঁকে পাশে পেয়েছিলাম অর্থসচিব হিসেবে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি কঠিন সময় তখন পার করতে হয়েছিল। সরকারি নথিতে স্বল্প বাক্যে কোনো গভীর সমস্যার চমৎকার ব্যাখ্যা তিনি লিপিবদ্ধ করতে পারতেন, পরবর্তীকালে যা তাঁর লেখালেখিতে সেই লেখনীর ক্ষমতায় আরও ব্যাপকভাবে ফুটে উঠেছে। এর সঙ্গে অবশ্য যুক্ত হয়েছে কোনো জটিল তাত্ত্বিক বিষয়কে কৌতুকমিশ্রিত প্রাঞ্জল ভাষায় প্রকাশ করার চমৎকার রচনাশৈলী।
লেখালেখিতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও গবেষণার অভিজ্ঞতাকে আকবর আলি খান চমৎকারভাবে কাজে লাগিয়েছেন; সে কারণে গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বাস্তব জীবনের অনেক সমস্যার তাত্ত্বিক কিন্তু সহজবোধ্য বিশ্লেষণ তিনি করতে পেরেছেন। এ কারণেই তাঁর লেখালেখি একদিকে আকর্ষণীয়, অন্যদিকে গভীর চিন্তাপ্রসূ।
তাঁর বাংলায় লেখা বিষয়ভিত্তিক জনপ্রিয় বইগুলো যেমন তত্ত্বগতভাবে জ্ঞানসমৃদ্ধ, তেমনি আবার এগুলোকে সাহিত্যকর্ম বলা চলে। তিনি ছিলেন এমন একজন চিন্তাবিদ, যিনি নির্মোহ গভীর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলমান আর্থসামাজিক পরিস্থিতি ও রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করেছেন।
ক্ষমতাসীন সরকারের দলীয় রাজনীতির সম্পূর্ণ ঊর্ধ্বে থেকে একজন সরকারি কর্মকর্তা অতিগুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে কী করে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে পারেন, তিনি তারও আদর্শ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। গণতান্ত্রিক সুশাসনের জন্য যে দৃষ্টান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারে যোগ দেওয়া থেকে শুরু করে সুদীর্ঘ ও বৈচিত্র্যময় কর্মজীবনের নানা ক্ষেত্রে তিনি তাঁর গভীর দেশপ্রেম ও সমাজ সচেতনতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। আমাদের সমাজে এমন দেশপ্রেমিক, মননশীল, জ্ঞানমনস্ক, নির্মোহ ও নির্লোভ মানুষের সংখ্যা ক্রমেই কমে যাচ্ছে। তাঁর চলে যাওয়ায় তাই সমাজ ও দেশের একটা বড় ক্ষতি হয়ে গেল। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।