ঢাকার রাস্তায় এলোপাতাড়ি গুলি
মাথায় গুলিবিদ্ধ ভুবনের জ্ঞান ফেরেনি, চিকিৎসার খরচ নিয়ে সংকটে পরিবার
ঢাকার রাস্তায় মোটরসাইকেলে করে যাওয়ার পথে মাথায় গুলিবিদ্ধ ভুবন চন্দ্র শীলের (৫২) জ্ঞান ফেরেনি তিন দিনেও। ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আইনি পরামর্শক ভুবন ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কবে নাগাদ ভুবনের জ্ঞান ফিরতে পারে, সে বিষয়ে চিকিৎসকেরা কোনো ধারণা দিতে পারছেন না। এদিকে তাঁর অত্যন্ত ব্যয়বহুল চিকিৎসার খরচের জোগান নিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন পরিবারের সদস্যেরা।
গত সোমবার রাত ১০টার দিকে তেজগাঁও শিল্প এলাকার বিজি প্রেসের সামনের রাস্তায় শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাঈদ ওরফে মামুনের প্রাইভেট কার লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে একদল সন্ত্রাসী। সেই সময় ওই পথ দিয়ে মোটরসাইকেলে করে আরামবাগে নিজের বাসার পথে থাকা ভুবন মাথায় গুলিবিদ্ধ হন। তখন ভুবনকে প্রথমে শমরিতা হাসপাতালে, পরে সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। রাত দেড়টার দিকে ভুবনকে পপুলার হাসপাতালে স্থানান্তর করেন স্বজনেরা। সেখানে তাঁকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে।
ভুবন চন্দ্র শীলের অবস্থা জানতে আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে পপুলার হাসপাতালের আইসিইউতে যোগাযোগ করা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক প্রথম আলোকে বলেন, ভুবন এখনো লাইফ সাপোর্টে আছেন। তাঁর জ্ঞান ফেরেনি। আজ পুনরায় তাঁর সিটি স্ক্যান করানো হয়েছে। এর প্রতিবেদন পাওয়া গেলে তাঁর মস্তিষ্কের অবস্থা জানা যাবে। তারপর তাঁর মাথায় অস্ত্রোপচার করা যাবে কি না, সে বিষয়ে একজন নিউরো সার্জনের পরামর্শ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ভুবন গোমতী টেক্সটাইল লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের আইনি পরামর্শক হিসেবে কাজ করতেন। গুলশানে তাঁর কার্যালয়। তাঁর স্ত্রী–সন্তান থাকেন নোয়াখালীতে। আরামবাগে একটি বাসায় থাকেন ভুবন চন্দ্র শীল। ওই রাতে গুলশানের কার্যালয় থেকে বাসায় ফেরার পথে গুলিবিদ্ধ হন তিনি।
ভুবনের আহত হওয়ার খবর শুনে ঢাকায় ছুটে এসেছেন তাঁর স্ত্রী রত্না রানী শীল ও একমাত্র মেয়ে সদ্য এসএসসি পাস করা ভূমিকা চন্দ্র শীল। তাঁরা পপুলার হাসপাতালের বারান্দা–সিঁড়িতে বসে অপেক্ষায় আছেন, কখন ভুবনের জ্ঞান ফিরবে।
রত্না রানী শীল আজ বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ও তাঁর মেয়ে তিন দিন ধরে হাসপাতালেই থাকছেন। তাঁদের একমাত্র অভিভাবকের জ্ঞান না ফেরায় উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা বাড়ছে। চিকিৎসকদের কাছে জানতে চাইলে তাঁরা পরিষ্কার কোনো ধারণা দিতে পারছেন না, কোনো আশাও দেখাচ্ছেন না।। চিকিৎসকেরা বলছেন, দোয়া করেন। তিনিও তাঁর স্বামীর জন্য সবার কাছে দোয়া চান।
পপুলার হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয়বহুল উল্লেখ করে রত্না রানী শীল বলেন, প্রতিদিনই বড় অঙ্কের অর্থ লাগছে।
ভুবন চন্দ্র শীলের চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন তাঁর শ্যালক তাপস মজুমদার। তিনি আজ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বোন রত্না রানী শীল নোয়াখালীর মাইজদির একটি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক। তবে তাঁর ভগ্নিপতিই ছিলেন পরিবারের মূল উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তিনি চাকরি থেকে মাসে ৩০–৪০ হাজার টাকার মতো বেতন পেতেন। ঢাকা থেকে ১৫–২০ দিন পরপর নোয়াখালীতে গিয়ে সংসারের খরচ দিয়ে আসতেন।
তাঁর বোন–ভগ্নিপতির সংসারে তেমন কোনো সঞ্চয় নেই জানিয়ে তাপস বলেন, প্রথম দিন এই হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ ৯৩ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। দ্বিতীয় দিনে বিল এসেছে ৬৭ হাজার টাকা। ধারদেনা করে হাসপাতালের বিল দিচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সামনের দিনগুলোতে কারও কাছ থেকে ঋণ পাওয়ারও কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। তখন কীভাবে চিকিৎসা করাব, তা বুঝতে পারছি না।’
ভগ্নিপতিকে বাঁচানোর জন্য সরকার ও বিত্তবানদের সহযোগিতার অনুরোধ জানিয়ে তাপস মজুমদার বলেন, চিকিৎসকেরা বলেছেন, ভুবন বেঁচে গেলে তাঁর দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা লাগবে। সে ক্ষেত্রে আগারগাঁওয়ে ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেসে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা এবং চিকিৎসার খরচ জোগানোর ব্যবস্থা করা গেলে পরিবারটি বেঁচে যাবে।
ভুবনের বাবা কৃষ্ণ কুমার শীল মারা গেছেন ২৩ বছর আগে। ভুবনের মা গিরিবালা শীলের বয়স ৭৫ বছর। তিনি ভুবনের স্ত্রী রত্না রানী শীলের সঙ্গে নোয়াখালীতে থাকেন। তিনিও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। স্মৃতিশক্তি হ্রাস পেয়েছে, কথা বলতে পারেন না। ভুবন মা-বাবার একমাত্র সন্তান।
স্বামী গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় রত্না রানী শীল গত মঙ্গলবার রাতে হাতিরঝিল থানায় অজ্ঞাতনামা সাত-আটজনকে আসামি করে হত্যাচেষ্টার মামলা করেছেন। তিন দিনেও ওই মামলায় পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. দুলাল হোসেন আজ প্রথম আলোকে বলেন, আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
হামলার সময় শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাঈদ ওরফে মামুন দুই সহযোগীকে নিয়ে প্রাইভেট কার থেকে বেরিয়ে পালানোর চেষ্টা করছিলেন। তখন সন্ত্রাসীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে মামুনের পিঠ ও ঘাড়ে কুপিয়ে জখম করে। আহত মামুন এখন বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে পরিদর্শক দুলাল হোসেন জানিয়েছেন।
শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন ও মামুন একসময় ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর ও তেজগাঁও এলাকার আতঙ্ক ছিলেন। তাঁদের গড়ে তোলা বাহিনীর নাম ছিল ‘ইমন-মামুন’ বাহিনী। তাঁরা দুজনই চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার আসামি। ইমন কারাগারে থাকলেও সম্প্রতি মামুন জামিনে বের হন। কারাগারে থাকা অবস্থাতেই দুজনের বিরোধ দেখা দেয়।
ইমন ও আহত মামুন চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলা ছাড়াও সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাই সাঈদ আহমেদ ওরফে টিপু হত্যা মামলার আসামি। প্রায় ২৪ বছর কারাগারে থেকে সম্প্রতি জামিনে মুক্ত হন মামুন। তিনি হামলার ঘটনা প্রসঙ্গে পুলিশকে বলেন, তাঁর ধারণা, কারাগারে থাকা সানজিদুল ইসলাম ইমনের নির্দেশে এ হামলা হয়েছে।