আপনি দিনাজপুর গিয়েছিলেন কেন?
আহসান হাবিব: একটি প্রশিক্ষণে অংশ নিতে।
ট্রেনে যে এক ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, সেটা জানলেন কীভাবে?
আহসান হাবিব: ট্রেনে থাকা রেলওয়ের লোকেরাই ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাঁরা জানতে চেয়েছিলেন, ট্রেনে কোনো চিকিৎসক রয়েছেন কি না।
অসুস্থ ব্যক্তি ছিলেন ‘গ’ নম্বর কোচে। কীভাবে গেলেন?
আহসান হাবিব: যখন ঘোষণা শুনি, তখন ট্রেনটি টাঙ্গাইল স্টেশনে থেমে ছিল। আমি ছিলাম ‘ড’ নম্বর কোচে। ট্রেনে সেদিন অনেক ভিড়। তাই ঘোষণা শোনার পর আমার ব্যাগ আসনে রেখে ট্রেন থেকে নেমে ‘গ’ কোচের দিকে হাঁটা শুরু করি। তবে কিছু দূর যাওয়ার পরই ট্রেন ছেড়ে দেয়। তখন আবার ট্রেনে উঠি। ট্রেনের একজন কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে ‘গ’ কোচে পৌঁছাই।
গিয়ে কী দেখলেন?
আহসান হাবিব: গিয়ে দেখি যাত্রী আবু সায়াদ চৌধুরী বুক চেপে ধরে হেলান দিয়ে বসে আছেন। তাঁকে ভিড় করে আছেন অন্য যাত্রীরা।
আপনি কী করলেন?
আহসান হাবিব: আমি পরিচয়পত্র দেখিয়ে জায়গাটা একটু ফাঁকা করতে বললাম। রোগীর কাছে গিয়ে দেখি তাঁর পালস (নাড়ির স্পন্দন) নেই বললেই চলে। রোগীর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। রোগীর স্ত্রীর কাছ থেকে রোগের ইতিহাস জেনে বুঝতে পারি তাঁর কার্ডিওভাসকুলার (হৃদ্রোগ) সমস্যা আছে।
হৃদ্রোগে আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসা দিতে যেসব ওষুধ লাগে তা কি ট্রেনে ছিল?
আহসান হাবিব: পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ প্রকল্পে আমার মেডিকেল অফিসার হিসেবে দুই বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। আমি শুনেছিলাম ট্রেনে ফার্স্ট এইড বক্স (প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম ও ওষুধ) থাকে। তবে দেখলাম, ট্রেনে এ ধরনের কিছু নেই।
তাহলে কী করলেন?
আহসান হাবিব: রেলের এক কর্মীকে বললাম, হার্টের (হৃদ্যন্ত্র) অসুখ আছে, ট্রেনে এমন কোনো যাত্রী আছেন কি না তা দেখার জন্য। এর মধ্যেই আমি রোগীকে বাঁচাতে সর্বশেষ প্রচেষ্টা হিসেবে বুকে চাপ দিয়ে অতি জরুরি সিপিআর (কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন) দেওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তবে এটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
হৃদ্যন্ত্রের অসুখ থাকা কোনো যাত্রী পাওয়া গিয়েছিল?
আহসান হাবিব: এক প্রবীণ যাত্রী তাঁর ওষুধের বাক্স নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। তাড়াহুড়োয় তাঁর নাম জানা হয়নি। আমার প্রাথমিকভাবে যেসব ওষুধ দরকার, তা ওই যাত্রীর কাছে পেলাম। দ্রুত রোগীকে ওষুধ খেতে দিলাম, জিহ্বার নিচে ওষুধ ‘স্প্রে’ করলাম। দেখি তাঁর পালস পাচ্ছি। রোগীর শরীরেও উষ্ণতা ফিরে আসছে।
ট্রেন তো চলছিল, রোগীকে হাসপাতালে নেওয়া সম্ভব হয়েছিল?
আহসান হাবিব: আমার বাড়ি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে। রোগীকে বাঁচাতে হলে তাঁকে হাসপাতালে নিতেই হবে। তখন পরিচালককে বললাম, ট্রেনটি মির্জাপুরে থামানোর জন্য। ওদিকে আমি আমার মাকে (হেলেনা আক্তার) ফোন করে রিকশা নিয়ে স্টেশনে থাকতে বলি।
ট্রেন কি থামানো হয়েছিল?
আহসান হাবিব: ট্রেনটি মির্জাপুরে থামানোর কথা ছিল না। তবে রোগীর জন্য থামানো হয়।
রোগীর সঙ্গে কে কে ছিলেন?
আহসান হাবিব: আবু সায়াদ চৌধুরীর সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী কাশফিয়া বেগম এবং তাঁদের ৯ বছর বয়সী ছেলে ও ৫ বছর বয়সী মেয়ে। সঙ্গে ব্যাগপত্র তো ছিলই।
মির্জাপুর নেমে কী করলেন?
আহসান হাবিব: স্টেশন থেকে বের হয়েই দেখি আমার মা রিকশা নিয়ে অপেক্ষা করছেন। তিনি প্রেশার মাপার যন্ত্র নিয়ে এসেছিলেন। আমি রোগীকে ওই রিকশা করেই কুমুদিনী উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করি। কিছু পরীক্ষার পর দেখা গেল রোগী ‘হার্ট অ্যাটাক’ করেছিলেন।
আপনার তো ঢাকায় ফেরার কথা ছিল...।
আহসান হাবিব: হাসপাতালে নেওয়ার পথে রিকশায় বসে আবু সায়াদ চৌধুরী আমার হাত চেপে ধরে শুধু কোনোরকমে বোঝালেন, আমি যাতে তাঁকে রেখে চলে না যাই। অসুস্থ মানুষটিকে রেখে চলে আসতে পারিনি। আমি তাঁর সঙ্গে সেদিন হাসপাতালে কয়েক ঘণ্টা ছিলাম। পরের দিন সকালে আবার যাই।
আবু সায়াদ চৌধুরী এখন কেমন আছেন?
আহসান হাবিব: তিনি ভালো আছেন।
আপনার এই ঘটনা নিয়ে তো গণমাধ্যমে প্রতিবেদন হয়েছে। কেউ কিছু বলেছে?
আহসান হাবিব: স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাসহ অনেকেই আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কেউ যোগাযোগ করেননি।
আপনার পরিবারে কে কে আছেন?
আহসান হাবিব: মা, বাবা, ভাই এবং আমার স্ত্রী।
আপনার মা রিকশা নিয়ে এলেন। তিনি কী বলেছিলেন?
আহসান হাবিব: তিনি আমার কাজে খুশি হয়েছিলেন।
ট্রেনে প্রাথমিক চিকিৎসার সুবিধা না থাকা নিয়ে কিছু বলবেন?
আহসান হাবিব: ট্রেনে দূরের যাত্রায় মানুষ অসুস্থ হতে পারেন। তাই প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ‘ফার্স্ট এইড বক্স’ থাকা উচিত। ট্রেনে রাখা সম্ভব না হলে বড় স্টেশনে রাখা যেতে পারে।