পাঠকের লেখা–৪৯
সেই রাতে আমার মা
প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]
সময়টা ১৯৬৬ সাল। বাংলাদেশ তখন পূর্ব পাকিস্তান। আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি।
রাজশাহীর সাগরপাড়ায় যে বাসাটায় আমরা থাকতাম, ঠিক তার পেছনেই বেশ বড় একটা মাঠ। এ মাঠ মিশেছে আমাদের বাসাটার দেয়ালে এসে। আমাদের বাসার দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে অনেকে বিশ্রাম নিত। দেয়াল মানে ঘরের দেয়াল, সীমানাদেয়াল নয়। কোনো সীমানাদেয়াল ছিল না।
মাঠঘেঁষা দেয়ালের ওপারে পাশাপাশি দুটি শোবার ঘর। দুই ঘরের দুই জানালা। জানালা খোলাই থাকত। মাঠ থেকে যে কেউ ঘরের ভেতরে হাত গলিয়ে দিতে পারত; কিন্তু কখনো এমনটা হয়নি।
দুটি শোবার ঘরের একটি মা-বাবার। আরেকটি বড় ভাইয়ের। বড় ভাই তখন রাজশাহী কলেজের ছাত্র। আমরা বাকি দুই ভাই পাশের আরেকটি কক্ষে থাকতাম।
ছোট মামা তখন ইংল্যান্ডে থাকেন। তিনি বড় ভাইকে উপহার দিলেন সুইজারল্যান্ডের তৈরি ফেভর লিউবা (Favre Leuba) হাতঘড়ি। এই ঘড়ি ঝুলিয়ে রাখার জন্য বড় ভাই দেয়ালে পেরেক গেঁথে রেখেছিলেন। সেখানেই কলেজ থেকে ফিরে ঘড়িটা ঝুলিয়ে রাখতেন। মাঠ থেকে খোলা জানালা দিয়ে সোজাসুজি অনেক কিছু দেখা গেলেও ঘড়িটা দেখা যেত না। এমনকি বাইরে থেকে হাত গলিয়েও ঘড়ির নাগাল পাওয়া সম্ভব ছিল না।
সেদিনও ছিল আর দশটা সাধারণ বিকেলের মতো। মাঠে খেলাধুলা শেষে সন্ধ্যায় হাত-মুখ ধুয়ে যে যার মতো পড়ার টেবিলে।
রাত নয়টা-সাড়ে নয়টা হবে। মা সব প্রস্তুত করে রাতের খাবারের জন্য ডাকছেন। এমন সময় বড় ভাইয়ের চিৎকার!
‘আমার ঘড়ি কই?’
এঘর-ওঘর, বইপত্র, বালিশের নিচে, শেলফের বইয়ের ফাঁকে ফাঁকে, সম্ভাব্য-অসম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ করা হলো। কোথাও পাওয়া গেল না বড় ভাইয়ের ফেভর লিউবাটা!
হঠাৎ মা বললেন, ‘খোকন একবার এসেছিল...।’
‘তো! খোকন এসেছিল তো কী হয়েছে?’
আব্বার জোরালো প্রশ্নে মা একটু চুপসে গেলেন।
‘না, আমি বলতে চাচ্ছি, ওরা সবাই যখন মাঠে খেলছিল, তখন খোকন একবার এসেছিল। এ ছাড়া তো বাইরের আর কেউ আসেনি।’
‘তুমি কি খোকনকে সন্দেহ করো?’
‘না...না...না।’ মা জবাব দিলেন দ্বিধার স্বরে।
২.
খোকন আমার বন্ধু। বড় বোনের সঙ্গে শহরের শিরোইল এলাকায় থাকে। বড় বোন তখন শহরের নামকরা গার্লস স্কুলের হেডমিস্ট্রেস।
ঘড়ির হদিস কোথাও পাওয়া গেল না। কীভাবে ঘড়িটা উধাও হতে পারে, এ নিয়ে কথা চলছেই।
হঠাৎ মা গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে আমার হাত ধরে টান দিলেন, ‘আমার সঙ্গে আয় তো...!’
‘কোথায়?’ হতভম্ব আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘খোকনদের বাসায় যাব। তুই সঙ্গে যাবি।’ মা বেশ দৃঢ় স্বরে বললেন।
রাত তখন সাড়ে ১০টার মতো। মা আমাকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে বাসার বাইরে নিয়ে এলেন।
মা আমার হাত ধরে হেঁটেই রওনা দিলেন। বড় ভাই, মেজ ভাই দৌড়ে এসে মাকে থামানোর চেষ্টা করল।
‘মা, তুমি প্রমাণ ছাড়া শুধু আন্দাজের ওপর ভর করে এত রাতে চুরির মতো এত বড় একটা অভিযোগ নিয়ে একজন সম্মানিত পরিবারে যাচ্ছ!’
মা কোনো কথাই শুনলেন না।
কিছু দূর হাঁটার পর একটা রিকশা পাওয়া গেল। সেই রিকশায় আমাকে নিয়ে উঠে পড়লেন মা।
রাজশাহী তখন নীরব নিঝুম একটি মফস্সল শহর।
খোকনরা বোধ হয় শোবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কেউ কেউ হয়তো বিছানায় চলেও গিয়েছিল।
এত রাতে চুরির মতো একটা অভিযোগ নিয়ে কোনো ভদ্রলোকের বাসায় যাওয়া, সত্যিই ঝুঁকিপূর্ণ। অপমানিত হওয়ার আশঙ্কা এক শ ভাগ।
খোকনের বোন, হেডমিস্ট্রেস, ভয়ানক ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। খোকন ঘড়ি চুরির ব্যাপারটা অস্বীকার করল।
মা বললেন, ‘বাবা, খোকন, তুমি তো বাসায় এসেছিলে?’
খোকন জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, গিয়েছিলাম। যখন শুনলাম আখতার নাই, আমি তো তখনই চলে এসেছি।’
মাকে কেমন যেন অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল।
হঠাৎ মা বলে উঠল, ‘তুমি কোন ঘরে থাকো?’
‘কেন, আপনি কি ওর ঘর সার্চ করবেন?’ বেশ ক্ষিপ্ত হয়েই বললেন হেডমিস্ট্রেস আপা।
‘হ্যাঁ, একটু দেখতে চাচ্ছি। আমার মন বলছে...!’ আমার মা বেশ সমানতালেই জবাব দিলেন।
অপমানিত, উত্তেজিত হেডমিস্ট্রেস আপার সামনে দিয়েই খোকনের ঘরে মা-সহ আমি গেলাম। কিছু পাওয়া গেল না।
হঠাৎ খোকনের ঘরের জানালাটা মা খুললেন। জানালার লোহার দুটি শিক দুই হাতে ধরে ঝুঁকে পড়ে বাইরে যেন কী দেখলেন।
বাইরে তখন গভীর অন্ধকার। মা সেই অন্ধকারেই ওদের বাসার পেছন দিকে এসে খোকনের ঘর বরাবর দাঁড়ালেন।
ঘাসে পরিপূর্ণ বেশ কিছুটা খোলা জায়গা। সেই অন্ধকারেই মা উবু হয়ে আঁতিপাঁতি করে পাগলের মতো হাত লাগিয়ে খুঁজতে শুরু করলেন।
একসময় সবাইকে অবাক করে দিয়ে ফেভর লিউবা ঘড়িটা পাওয়া গেল।
পুরো ব্যাপারটা আমার জন্য কিছুটা হলেও অস্বস্তিকর ছিল; কারণ, খোকন আমার বন্ধু ছিল।