দেশে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ও পোস্টগ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। চিকিৎসকদের পাশাপাশি অন্য পেশাজীবী বা অন্য বিষয়ে পড়াশোনা করা ব্যক্তিরাও (নন–মেডিকেল) জনস্বাস্থ্য বিষয়ে পড়াশোনা করছেন। তবে এ ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে চাকরি খুঁজে পাওয়া। জনস্বাস্থ্য বিষয়ে আন্ডারগ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে ৫৭ শতাংশই চাকরি খুঁজে পেতে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে।
আজ বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের (বিএইচডব্লিউ) প্রকাশিত নবম প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক টাওয়ারে ‘স্টেট অব প্রফেশনাল পাবলিক হেলথ এডুকেশন ইন বাংলাদেশ’ (বাংলাদেশে পেশাদারি জনস্বাস্থ্য শিক্ষা পরিস্থিতি) শিরোনামে বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের ২০২৩–২৪ সালের প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বলা হয়, চাকরি খুঁজে পেতে মেডিকেলের চেয়ে নন–মেডিকেল ব্যক্তি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েট ব্যক্তিরা বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছেন। ২০২৩ সালের নভেম্বরে ৩০০ জন আন্ডারগ্র্যাজুয়েটের ওপর জরিপ পর্যালোচনায় এ তথ্য উঠে আসে। বিএইচডব্লিউ বহু অংশীজনভিত্তিক নাগরিক সংগঠনগুলোর একটি উদ্যোগ। তাদের প্রথম প্রতিবেদনটি প্রকাশ হয় ২০০৬ সালে।
আজ প্রকাশিত নবম প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি প্রতিষ্ঠান, মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর চাকরি পাওয়ার সময়ে তাঁরা নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়েন। দুটি সরকারি প্রতিষ্ঠান—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা গ্র্যাজুয়েটরা বেশি চ্যালেঞ্জে পড়েছেন। সবচেয়ে কম চ্যালেঞ্জে পড়েছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।
সাতটি প্রতিষ্ঠানের আলাদা স্কোর তুলে ধরে প্রতিবেদনে জানানো হয়, চাকরি খুঁজতে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছেন বিএসএমএমইউ গ্র্যাজুয়েটরা (প্রায় ৮২ শতাংশ)। এরপর রয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (৬৪ শতাংশের বেশি), ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (৫৯ শতাংশের বেশি), জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম) (৫৮ শতাংশের বেশি), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় (জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ) (৫৫ শতাংশের বেশি) এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় (৪০ শতাংশের বেশি)। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে এই চ্যালেঞ্জ ৬৯ শতাংশের বেশি। তবে জরিপে সব প্রতিষ্ঠানের সমানসংখ্যক গ্র্যাজুয়েটের অংশগ্রহণ ছিল না।
চাকরি পেতে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়ার পেছনে জনস্বাস্থ্যবিষয়ক চাকরি ও গবেষণার সুযোগ কম থাকা, চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার দিকে নজর দিয়ে শিক্ষাক্রম তৈরি না করা, মানসম্মত শিক্ষকের অভাবকে দায়ী করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রতিবেদনের অন্যতম লেখক সেন্টার ফর প্রফেশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট অন পাবলিক হেলথের পরিচালক আতাউর রহমান বলেন, অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষক এনে পড়ানো, জনস্বাস্থ্য শিক্ষায় শুরুতে ঝরে পড়ার হার বেশি থাকা চাকরির জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য শিক্ষা বিষয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে যোগাযোগ দক্ষতা বেশি থাকায় এবং শিক্ষাক্রমে ভিন্নতার কারণে তাঁরা তুলনামূলক কম চ্যালেঞ্জে পড়ছেন।
বক্তারা বলেন, জনস্বাস্থ্য কতটা জরুরি বিষয় তা কোভিড–১৯ মহামারি মানুষকে আরও বুঝিয়েছে। ঘাটতি মোকাবিলায় জনস্বাস্থ্য শিক্ষাক্রমের সংস্কার, শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়ানো, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে নজরদারি বাড়ানো, কমিউনিটিভিত্তিক প্রশিক্ষণ বাড়ানো, বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ানো, চাকরির বাজার অনুসারে দক্ষতা বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে বিএইচডব্লিউয়ের উপদেষ্টামণ্ডলীর আহ্বায়ক ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক রওনক জাহান বলেন, এখন স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠন হয়েছে। সুযোগ এসেছে জনস্বাস্থ্যবিষয়ক শিক্ষার ক্ষেত্রে কিছু বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে সুপারিশ করার। সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অংশীদারি, অভিজ্ঞতা বিনিময়, শিক্ষাক্রমে মান বজায় রাখা এবং সমন্বয় করা দরকার। ডায়রিয়া ও টিকার মতো জনস্বাস্থ্য বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত উদ্যোগ ব্যাপক সফলতা এনেছে। জনস্বাস্থ্য শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। আগামী দিনে জনস্বাস্থ্য বিষয়টিতে সুশাসন অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। নারী নির্যাতনের বিষয়গুলোকে জনস্বাস্থ্যের অধীনে এনে নজরদারি রাখা দরকার। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবাও চালু করতে হবে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব মো. সারোয়ার বারী বলেন, সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে জনস্বাস্থ্য শিক্ষায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। শুধু তাত্ত্বিক পড়াশোনা নয়, জনস্বাস্থ্য বিষয়ে পড়াশোনার সুফলকে কমিউনিটি পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। ডায়রিয়ায় শিশু মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে কমিউনিটি পর্যায়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি ও প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম নেওয়ায়। তাই প্রতিরোধ ও প্রচারের ওপর গুরুত্ব দিয়ে জনস্বাস্থ্যবিষয়ক শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। জনস্বাস্থ্য শুধু মেডিকেল ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিষয় নয়, সব মন্ত্রণালয়ের কাজের মধ্যে জনস্বাস্থ্যের বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন সুইডেনের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহায়তা প্রতিষ্ঠানের (সিডা) স্বাস্থ্য উপদেষ্টা মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম, ইউএসএইডের জনসংখ্যা কার্যালয়ের উপকার্যালয় পরিচালক (স্বাস্থ্য ও পুষ্টি) মিরান্ডা বেকম্যান, স্টেট ইউনিভার্সিটির জনস্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান ও ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক নওজিয়া ইয়াসমিন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বিএইচডব্লিউয়ের আহ্বায়ক আহেমদ মোশতাক রাজা চৌধুরী। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বিএইচডব্লিউয়ের কর্মসূচি পরিচালক শেখ মাসুদুল আলম। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএইচডব্লিউয়ের গবেষণা সমন্বয়কারী মাহরুবা খানম। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বিএইচডব্লিউয়ের কর্মসূচি কর্মকর্তা ইমরুল সিফাত।