গণশৌচাগারকে নাগরিকবান্ধব করতে হবে

‘নগরের স্যানিটেশন–ব্যবস্থার উন্নয়নে স্থানীয় সরকার সংস্কার প্রস্তাব’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে ফারহানা রশীদ, হাসিন জাহান, মোহাম্মদ ফিদা হাসান, তোফায়েল আহমেদ, মইনুল ইসলাম ও মোতাকাব্বীর আহমেদ। আজ বুধবার বিকেলে রাজধানীর প্রথম আলো কার্যালয়েছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

সিটি করপোরেশন বা পৌরসভায় প্রয়োজনের চেয়ে গণশৌচাগারের সংখ্যা একেবারেই কম। নারীসহ সব শ্রেণির মানুষকে এ ধরনের শৌচাগার ব্যবহারে উৎসাহিত করা যায়নি। এ ছাড়া চাহিদা অনুযায়ী জায়গায় শৌচাগার নির্মাণ হয়নি। গণশৌচাগারকে রাজস্ব আদায়ের মাধ্যম বিবেচনা না করে নাগরিকবান্ধব সেবা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে এবং কমিউনিটিকে পরিচালনায় যুক্ত করতে হবে।

আজ বুধবার বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে ‘নগরের স্যানিটেশন–ব্যবস্থার উন্নয়নে স্থানীয় সরকার সংস্কার প্রস্তাব’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা উঠে আসে। ওয়াটারএইড বাংলাদেশ, উন্নয়ন সংস্থা ভূমিজ ও প্রথম আলোর উদ্যোগে এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়।

বৈঠকের শুরুতে ওয়াটারএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিন জাহান মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, এখনো শৌচাগারকে নারীবান্ধব করা যায়নি। সিটি করপোরেশন গণশৌচাগারগুলোকে নাগরিক সেবা হিসেবে নিশ্চিত না করে শুধু রাজস্ব আয়ের উপায় হিসেবে মনে করে। গণশৌচাগার রক্ষণাবেক্ষণে স্থানীয় সরকার যথাযথ ও সঠিক সময়ে ভূমিকা পালন না করায় মানসম্পন্ন ব্যবস্থাপনা সম্ভব হয় না। নগরজুড়ে স্যানিটেশন–বিষয়ক কোনো সমন্বিত মাস্টারপ্ল্যান (মহাপরিকল্পনা) না থাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণ গণশৌচাগার নিশ্চিত করা যায়নি।

স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান তোফায়েল আহমেদ বক্তব্যে বলেন, স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে নাগরিকবান্ধব করতে হলে শৌচাগারকে সেবা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এখানে সমস্যাগুলো সহজ কিন্তু তা সমাধান জটিল হয়ে রয়েছে। এখন সুযোগ এসেছে সমস্যাগুলো ধরে ধরে তা সমাধানে দ্রুত কাজ করা।

শৌচাগার পরিচালনায় দুর্বৃত্তায়ন উৎখাত করতে হবে জানিয়ে এই স্থানীয় সরকারবিশেষজ্ঞ বলেন, সিটি করপোরেশন, পৌরসভার কোন বিভাগ কীভাবে কাজ করবে, সেটা ঠিক করতে হবে। সব কাজের জন্য সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। সেবামূলক এই কাজে স্থানীয় কমিউনিটিকে যুক্ত করতে হবে।

পাশাপাশি নাগরিকদের শিক্ষিত করার ওপরও জোর দেন তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার সভ্যতার মাপকাঠি। সমাজ সভ্য না হলে এগুলো ঠিক করা কঠিন। একটি শহরের অনেক অংশীজন থাকে। প্রত্যেকের জন্য নীতি থাকতে হবে। শৌচাগার নির্মাণকে ভালো কাজের উদ্যোগ হিসেবে দেখতে হবে। এটা নিয়ে প্রচার করতে হবে। এতে দেখা যাবে ব্যবসায়ীসহ অনেকেই এগিয়ে আসবেন।

অনুষ্ঠানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফিদা হাসান বলেন, ইজারার চেয়ে এটাকে সেবা হিসেবে দেখা যেতে পারে এবং কোন বিভাগ দেখবে তা নির্ধারণ করা জরুরি। গণশৌচাগারকে গুরুত্ব দিতে হবে। গণশৌচাগার ব্যবহার করা শেখার বিষয়। শিশুকাল থেকে শিক্ষাব্যবস্থায় বিষয়গুলো আসা উচিত।

ফিদা হাসান আরও বলেন, রাজনৈতিক দখলবাজি, চাঁদাবাজির বিষয়গুলো থাকলে কিছুই করা যাবে না। এখন পরিবর্তনের জন্য ভালো সময় বিরাজ করছে। এখনই এটির সঠিক ব্যবস্থাপনায় নজর দেওয়া দরকার।

শৌচাগার পরিচালনায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ তুলে ধরে ডিএনসিসির নির্বাহী পরিচালক মোতাকাব্বীর আহমেদ বলেন, গণশৌচাগারকে সেবাবান্ধব করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা লাগবে। দৃষ্টিনন্দন পার্ক হয়, কিন্তু ইজারার কারণে অনেক সময় পার্কের ফটক বা শৌচাগারের ফটক বন্ধ রাখা হয়। এগুলো উন্মুক্ত থাকা উচিত। শৌচাগার ব্যবস্থাপনায় আরও তদারকি প্রয়োজন। এ ছাড়া শৌচাগার নির্মাণের ক্ষেত্রে চাহিদা বিবেচনা করে স্থান নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ।

‘নগরের স্যানিটেশন–ব্যবস্থার উন্নয়নে স্থানীয় সরকার সংস্কার প্রস্তাব’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আজ বুধবার বিকেলে রাজধানীর প্রথম আলো কার্যালয়ে
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নগর–পরিকল্পনাবিদ মো. মঈনুল ইসলাম বলেন, ২০ লাখ মানুষের জন্য নারায়ণগঞ্জে ১৩টি শৌচাগারের মধ্যে ৪টি পরিচালিত হচ্ছে। প্রয়োজনের তুলনায় যা অপ্রতুল।

নগরের বিভিন্ন স্থানে শৌচাগার পরিচালনার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে উন্নয়ন সংস্থা ভূমিজের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফারহানা রশীদ বলেন, সঠিক জায়গা, সঠিক নকশা ও সঠিক পরিচালনা পদ্ধতি না থাকার মধ্য দিয়ে কাজটা করতে হচ্ছে। সরকারিভাবে সঠিক জায়গায় এবং সঠিক নকশায় গণশৌচাগার হতে হবে। তাহলে শৌচাগারগুলো পরিচালনা–সুবিধা হবে।

প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে ফারহানা রশীদ বলেন, কত মানুষ ব্যবহার করছে, কোন শৌচাগারের পরিচ্ছন্নতার মান কেমন—এসব তদারকি করা গেলে ঘাটতি ও অনিয়ম মোকাবিলা করা সম্ভব। এ ছাড়া ইজারার শর্তগুলোতে শৌচাগার পরিচালনায় অভিজ্ঞতার মাপকাঠি যুক্ত করার আহ্বান জানান তিনি।

সাজিদা ফাউন্ডেশনের উপপ্রধান নির্বাহী ফজলুর রহমান বলেন, শৌচাগার ব্যবহারে নারীসহ সব শ্রেণির মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য ক্যাম্পেইন (প্রচারণা) ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কমাতে হবে।

ঢাকার বাইরে গণশৌচাগারের পরিস্থিতি আরও খারাপ উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা এসএনভি বাংলাদেশের ব্যবসাবিষয়ক উপদেষ্টা মীর তানভীর আহমেদ চৌধুরী বলেন, সেখানে ইজারা দেওয়ার পদ্ধতিও অনেক সময় কাগজে–কলমে থাকে না। সেবামূলক কাজগুলো পরিচালনার জন্য সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার জন্য একটি সঠিক নীতি ও পরিকল্পনা থাকা দরকার।

গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন দুস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিচালক (ওয়াশ) এম এ হাকিম, ওয়াটারএইড বাংলাদেশের পলিসি অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি পরিচালক পার্থ হেফাজ সেখ, গাবতলী গণশৌচাগারের ইজারাদার সানিউল আহমেদ, গণশৌচাগার ব্যবহারকারী হাফিজুর রহমান প্রমুখ।

গোলটেবিল বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।

আরও পড়ুন