এই রক্তরঞ্জিত ভোরে

শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও গণভবন অভিমুখে লাখো মানুষ। গতকাল রাজধানীর বিজয় সরণিতেছবি: খালেদ সরকার

আজ ভোরে যে সূর্য উদিত হয়েছে, তা এক নতুন সূর্য। চার শতাধিক ছাত্র-জনতার রক্তে সেটি রঞ্জিত। এই রক্তরঞ্জিত সূর্যের উদয় ঘটেছে এক নতুন সম্ভাবনা নিয়ে।

গত কয়েক দিনে দেশ আক্ষরিক অর্থেই এক মৃত্যু-উপত্যকা পার হয়ে এসেছে। ১ জুলাই ছাত্ররা যখন সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটার অবসানের দাবি জানিয়ে আন্দোলন শুরু করেছিলেন, সেটি তখন ছিল আপাদমস্তক অহিংস। কিন্তু প্রথমে শেখ হাসিনার দম্ভোক্তি ও একগুঁয়েমি এবং পরে নিরীহ ছাত্রদের ওপর তাঁর দল ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সহিংস আক্রমণের কারণে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে পড়ে। ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ শহীদ হলে তা পুরো দেশের হৃদয়ে আঘাত করে। শেখ হাসিনা মুখে সংলাপের কথা বললেও ছাত্র-জনতার ওপর নিষ্ঠুর আক্রমণ চলতে থাকে। গতকাল পর্যন্ত রক্ষণশীল হিসাবেও চার শর বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। আহত মানুষের সংখ্যা সাত হাজারের বেশি। আটক করা হয়েছে প্রায় ১২ হাজার মানুষকে। মামলা করা হয়েছে প্রায় ৮০০, যার উল্লেখযোগ্য অংশই গণমামলা।

প্রথমে শেখ হাসিনার দম্ভোক্তি ও একগুঁয়েমি এবং পরে নিরীহ ছাত্রদের ওপর তাঁর দল ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সহিংস আক্রমণের কারণে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে পড়ে।

এই চরম নিষ্পেষণের প্রেক্ষাপটে ছাত্রদের সঙ্গে দেশজুড়ে যোগ দিতে শুরু করে সাধারণ জনতা-কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, শিক্ষক, আইনজীবী, অভিভাবক, নারীসমাজ, শিল্পী, শ্রমিক ও পেশাজীবীরা। এই জনতার কাতারে বহু আওয়ামী বা বিএনপি-অনুরাগী এবং বাম-ডান একাকার হয়ে যায়। এক অভূতপূর্ব গণজাগরণ ভাসিয়ে নিয়ে যায় দেশকে। ছাত্রদের কোটাবিরোধী ৯ দফার আন্দোলন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফার আন্দোলনে পরিণত হয়।

কিন্তু এই এক দফা আন্দোলনের পটভূমি নিছক গত ৩৬ দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর উৎস শেখ হাসিনা সরকারের গত ১৫ বছরের শ্বাসরোধী স্বৈরাচারী শাসনকাল। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা নির্বাচনব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করে তাঁর একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। শাসনকে কঠোর থেকে কঠোরতর করে তোলেন। তাঁর শাসনামলে বিরোধী দল ও কণ্ঠকে নিষ্ঠুরভাবে নির্বাপণ করা হয়, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ন্যুব্জ করা হয়, অবরুদ্ধ করা হয় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। এ সময়ে ছয় শতাধিক মানুষকে গুম করা হয়। তাঁদের মধ্যে ১৭০ জনেরও বেশি মানুষের কোনো খোঁজ আজ অব্দি পাওয়া যায়নি। গণমামলায় আটক বা দুর্বিষহ অবস্থায় ছিলেন বিরোধী দলের অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মী। এ সময়ে দুর্নীতি, স্বজন-তোষণ, ব্যাংক লুট আর বিপুল অর্থ পাচারে দেশের অর্থনীতি পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। অর্থনীতির প্রবল নিম্নচাপে সাধারণ মানুষের জীবন হয়ে ওঠে ওষ্ঠাগত। এই গণজাগরণে তারই পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছে, যার অনিবার্য পরিণতি শেখ হাসিনার গত ১৫ বছরের অপশাসনের বিদায়ে।

এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা এক নতুন ছাত্রশক্তির অভ্যুদয় লক্ষ করলাম। শিক্ষার্থীরা যে প্রজ্ঞায়, সাহসে ও নেতৃত্বে এই আন্দোলনকে সফল করে তুললেন, তাকে অভিবাদন জানাই। সারা দেশের জনতা নির্ভীক চিত্তে যেভাবে এ আন্দোলন বেগবান করে তুলল, তাকেও জানাই অভিনন্দন। একটি নতুন যুগের উন্মেষ ঘটাতে এ সময়ে যাঁরা নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিলেন, জাতি তাঁদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। তাঁদের জন্য আমরা একই সঙ্গে শোকে আনত এবং গর্বে উন্নত–শির। বাংলাদেশের ইতিহাসে আমরা এক অসাধারণ সময়ের সাক্ষী হয়ে রইলাম।

আপামর জনতা একটি কঠিন রক্তস্নাত অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে অপশাসনের জগদ্দল পাথরকে ভেঙে চূর্ণ করেছে। ভাঙার সময়কে আমরা পেছনে ফেলে এসেছি। এখন গড়ে তোলার সময়। শেখ হাসিনার দুর্নীতি-জর্জরিত একনায়কতন্ত্রের পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা বিজয় অর্জন করেছে। যে প্রতিহিংসার রাজনীতি দেশবাসীর কণ্ঠে চেপে বসেছিল, তার অবসান ঘটেছে।

রাজধানীসহ দেশের নানা অঞ্চলে আমরা বিভিন্ন হিংসাত্মক ঘটনা দেখতে পাচ্ছি। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপরও আক্রমণের ঘটনা ঘটছে। এমন একটি সফল গণ–আন্দোলনের পর এসব ঘটনা খুবই দুঃখজনক। গতকাল সেনাপ্রধান তাঁর ভাষণে সংঘর্ষ, ভাঙচুর, অরাজকতা থেকে সবাইকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। আমরাও সবাইকে সে অনুরোধ জানাই। একটি প্রতিহিংসাপরায়ণ সরকারের পতন ঘটানোর পর আর কোনো হামলা, অগ্নিসংযোগ, ধ্বংসযজ্ঞ বা মৃত্যু কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।

অর্থনীতির প্রবল নিম্নচাপে সাধারণ মানুষের জীবন হয়ে ওঠে ওষ্ঠাগত। এই গণজাগরণে তারই পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছে, যার অনিবার্য পরিণতি শেখ হাসিনার গত ১৫ বছরের অপশাসনের বিদায়ে।

জাতি-ধর্ম-দল-নির্বিশেষে দেশের সব মানুষ আজ একই মুক্ত সমতলে দাঁড়িয়ে নতুন তাজা হাওয়ায় নিশ্বাস নিচ্ছে। নতুন সূর্যকিরণে আজ আমরা সবাই উদ্ভাসিত। সবাই সংযত থেকে সব মানুষকে আমরা অবশ্যই এই নতুন গণতান্ত্রিক সময়ের ভাগীদার করে তুলব।

মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে নানা গণ-অভ্যুত্থানে মানুষের স্বপ্ন আকাশচুম্বী হয়েছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে সেসব স্বপ্ন ভেঙেও পড়েছে। রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের পবিত্র চুক্তি প্রতিটি সরকার চূর্ণ করেছে। এই আন্দোলন নতুন যে প্রতিশ্রুতি বয়ে এনেছে, তাকে সফল করে তুলতে হলে অভিজ্ঞতার সঙ্গে নবীনতার মিলন ঘটাতে হবে। দেশের প্রাজ্ঞ নাগরিক-সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নতুন ছাত্রশক্তির সংলাপের ভিত্তিতে সামনের দিনের পথ রচিত হোক। স্বাধীনতার পর থেকে আমরা একদলীয় সরকার, সামরিক স্বৈরাচার, নির্বাচিত স্বৈরশাসন ও একনায়কতন্ত্র দেখেছি। এবার জনগণের অংশগ্রহণ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ভিত্তিতে আমরা সার্বিক অর্থে একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পেতে চাই।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও শকতি।’ আমাদের হাতে এখন একটি সফল আন্দোলনের পতাকা উড়ছে। আমরা যেন একে ঠিকভাবে বহন করে সামনে এগিয়ে যেতে পারি।