ফৌজদারি মামলা তদন্তের জন্য পুলিশের বাইরে সংস্থার প্রস্তাব

  • ফৌজদারি মামলা তদন্তে এখন থানা-পুলিশের পাশাপাশি সিআইডি ও পিবিআই রয়েছে।

  • প্রস্তাবিত তদন্ত সংস্থায় জনবল হবে পুলিশ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

ফৌজদারি অপরাধের মামলা তদন্তের জন্য আলাদা সংস্থা গঠন করা প্রয়োজন বলে মনে করে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। সংস্থাটি হবে দক্ষ ও নির্ভরযোগ্য, যাতে প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারে। একই সঙ্গে বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ফেরাতে একটি স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেছে কমিশন।

কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদনে এসব প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনটি সম্প্রতি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।

বর্তমানে ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত করে পুলিশ। থানা-পুলিশের পাশাপাশি অপরাধ তদন্তে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) রয়েছে। এর মধ্যে পিবিআই যাত্রা শুরু করে ২০১২ সালে। তবে এসব ইউনিট পুলিশের অধীনে পরিচালিত হয়। নিয়োগ হয় পুলিশ থেকে বদলির মাধ্যমে।

ফৌজদারি মামলার তদন্ত করে পুলিশ। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন মনে করে, তদন্তে আলাদা সংস্থা দরকার।

বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন যে তদন্ত সংস্থার কথা বলছে, তার কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে প্রাথমিক প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, সংস্থাটির জনবল পুলিশ বাহিনী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হবে। তাদের নিয়োগ, চাকরির শর্ত, বাজেট, অবকাঠামো ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি একটি স্বতন্ত্র সংগঠন ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোভুক্ত হবে। সাধারণভাবে প্রস্তাবিত সংস্থা কাজ শুরু করবে মামলা দায়েরের পর। এই সংস্থার তদন্ত কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট অ্যাটর্নি বা প্রসিকিউটরের তদারকিতে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। 

বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য আইনজীবী তানিম হোসেইন শাওন প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিক প্রতিবেদনে সংস্কার কমিশনের কার্যক্রম, ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় যথাযথ ও প্রভাবমুক্ত তদন্ত নিশ্চিতে স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থা গঠন; স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠা এবং স্বল্প ব্যয়ে ও স্বল্প সময়ে কার্যকর বিচারপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ তুলে ধরা হয়েছে। এগুলোর পাশাপাশি বিচার বিভাগের আর্থিক স্বাধীনতা, পর্যাপ্ত বাজেট নিশ্চিত করাসহ বেশ কয়েকটি বিষয় কমিশনের বিবেচনায় রয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এসবের প্রতিফলন থাকবে।

পুলিশকে বহু ধরনের কাজ করতে হয়। যদি আলাদা করে একদল শুধু তদন্তের জন্য নিয়োজিত থাকে, তাহলে তাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বাড়বে। তদন্ত সঠিক ও যথার্থ হবে।
শাহদীন মালিক, আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট

বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের সুপারিশ পেতে অন্তর্বর্তী সরকার ১১টি কমিশন গঠন করেছে, যার একটি বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানকে প্রধান করে আট সদস্যের এই কমিশন গঠন করা হয় গত ৩ অক্টোবর। ৯০ দিনের মধ্যে কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা। সময়সীমা গতকাল শুক্রবার শেষ হয়। তবে সময়সীমা ইতিমধ্যে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। কমিশন এর আগে একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।

প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় তদন্ত একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। তদন্ত কর্মকর্তা সৎ, সাহসী, দক্ষ ও পেশাদার না হলে তদন্ত প্রতিবেদনে নানা রকম দুর্বলতা থেকে যায়। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবসহ নানা কারণে যথাযথভাবে প্রকৃত তথ্য প্রতিফলিত হয় না। দ্রুত ও মানসম্পন্ন তদন্তের ওপর মামলার ফলাফল অনেকাংশে নির্ভরশীল।

কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মুহাম্মদ নুরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, ‘গোটা পৃথিবীতে পুলিশ ফৌজদারি মামলার তদন্ত করে। তবে ফ্রান্সে ম্যাজিস্ট্রেটদের তদন্তের উদাহরণ আছে। আমরা তদন্তের জন্য সিআইডি, পিবিআই ও দুদকের (দুর্নীতি দমন কমিশন) মতো সংস্থা করেছি। এরপরও কেন নতুন তদন্ত সংস্থার প্রয়োজন হবে, সেটি পরিষ্কার নয়।’ তিনি বলেন, বিদ্যমান ব্যবস্থায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তার তদন্তে আইজিপিরও কিছু বলার ক্ষমতা নেই। এরপরও তো প্রভাব বিস্তারের ঘটনা ঘটেছে। এগুলো হয়েছে মূলত রাজনৈতিক কারণে। নতুন সংস্থা হলে যে সেখানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হবে না, সেই নিশ্চয়তা কে দেবে।

আইনজীবীরা বলছেন, দেশে সার্বিকভাবে ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্তদের দোষী প্রমাণিত হওয়ার হার কম-বেশি ২০ শতাংশ। ৮০ শতাংশই খালাস পেয়ে যায়। এর কারণ, তদন্তে ঘাটতি। থানা-পুলিশের একেকজন তদন্ত কর্মকর্তার কাছে অনেক মামলা থাকে। তাঁদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নানা কাজ থাকে। ফলে সব মামলার তদন্তে প্রয়োজনীয় সময় দিতে পারেন না তদন্ত কর্মকর্তা। অনেকের বিরুদ্ধে প্রভাবশালীর চাপে তদন্ত ভিন্ন খাতে নেওয়া এবং ঘুষ গ্রহণের অভিযোগও রয়েছে।

দুর্নীতি প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করা সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) গত মাসে ‘সেবা খাতে দুর্নীতি: জাতীয় খানা জরিপ ২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জানায়, দেশে সর্বোচ্চ ঘুষ গ্রহণকারী পাঁচটি খাত হলো পাসপোর্ট, বিআরটিএ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, বিচারিক সেবা ও ভূমি খাত।

গোটা পৃথিবীতে পুলিশ ফৌজদারি মামলার তদন্ত করে। তবে ফ্রান্সে ম্যাজিস্ট্রেটদের তদন্তের উদাহরণ আছে। আমরা তদন্তের জন্য সিআইডি, পিবিআই ও দুদকের (দুর্নীতি দমন কমিশন) মতো সংস্থা করেছি। এরপরও কেন নতুন তদন্ত সংস্থার প্রয়োজন হবে, সেটি পরিষ্কার নয়।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মুহাম্মদ নুরুল হুদা

মিথ্যা মামলা ও হেনস্তা

সংস্কার কমিশন বলেছে, একটি বড় সমস্যা হলো মিথ্যা মামলা। অনেক ক্ষেত্রে দোষী ব্যক্তিদের সঙ্গে নির্দোষ ব্যক্তিদেরও মামলায় যুক্ত করা হয়। আবার প্রকৃত ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করা হয় বা মূল ঘটনাকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধামাচাপা দেওয়া হয়। এসব ক্ষেত্রে তদন্ত সুষ্ঠু না হলে নিরপরাধ ব্যক্তির হয়রানির আশঙ্কা থাকে বা প্রকৃত অপরাধী ছাড়া পেয়ে যায়। বিরোধী পক্ষকে হয়রানির উদ্দেশ্যে মিথ্যা মামলা দায়ের ও পুলিশকে ব্যবহারের মাধ্যমে হেনস্তার ঘটনা অহরহ ঘটে থাকে।

সংস্কার কমিশন বলছে, পুলিশের কিছু সদস্যের দুর্নীতি, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও অসৎ উদ্দেশ্যে পুলিশকে যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে পুলিশের ব্যাপারে একধরনের ভীতি কাজ করে। এ ছাড়া তদন্তকাজ পরিচালনায় পুলিশের কোনো একক ইউনিট নেই; বরং একাধিক বিভাগকে একই ধরনের কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। পুলিশের তদন্ত ব্যবস্থা যথেষ্ট সুসংগঠিত ও সুদক্ষ নয়। সমন্বয়ের অভাবে অনেক ক্ষেত্রেই যথাযথ সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই আদালতে মামলার বিচার শুরু হয় এবং শেষ পর্যন্ত অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যায়।

সংস্কার কমিশন মনে করে, স্বতন্ত্র, কার্যকর, দক্ষ, নির্ভরযোগ্য, জনবান্ধব এবং প্রভাবমুক্ত তদন্ত সংস্থা গঠন করা প্রয়োজন।

অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠনের প্রস্তাব

প্রাথমিক প্রতিবেদনে অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠনের প্রস্তাবের পক্ষে তথ্য ও যুক্তি তুলে ধরেছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর ভাষ্য, এ পর্যন্ত অ্যাটর্নি জেনারেলসহ সর্বস্তরের আইন কর্মকর্তা নিযুক্ত হয়েছেন মূলত অস্থায়ীভাবে এবং রাজনৈতিক বিবেচনায়। আইন কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালন বিষয়ে জবাবদিহির কোনো আইনি কাঠামো নেই। যোগ্যতা বা দক্ষতা বা সততা নয়, মূলত আইন কর্মকর্তাদের নিয়োগকে বিবেচনা করা হয় রাজনৈতিক আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে।

এ ছাড়া অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস ছাড়া জেলা পর্যায়ে কোনো আইন কর্মকর্তার জন্য পৃথক অবকাঠামো, সহায়ক জনবল, বাজেট বা আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। ফৌজদারি মামলার তদন্তকারী ব্যক্তি অথবা সংস্থার সঙ্গে আইন কর্মকর্তাদের মতামত গ্রহণ বা গুরুত্ব দেওয়ার বাধ্যবাধকতাও নেই। জেলা পর্যায়ের আইন কর্মকর্তার জন্য নির্ধারিত পারিশ্রমিক অতি নগণ্য। তাঁদের দায়িত্ব পালনের মান মোটেও সন্তোষজনক নয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে একটি স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন বলে কমিশন মনে করে।

প্রাথমিক প্রতিবেদনে প্রস্তাবিত অ্যাটর্নি সার্ভিসের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। এর ভাষ্য, অ্যাটর্নি সার্ভিস হবে একটি স্থায়ী সরকারি চাকরি। সার্ভিসের সুনির্দিষ্ট কাঠামো, নিয়োগপদ্ধতি, পদোন্নতি, বদলি, শৃঙ্খলা, বেতনকাঠামোসহ আর্থিক সুবিধাদি এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ে যথাযথ বিধানসংবলিত আইন থাকবে। পর্যাপ্ত অবকাঠামো, বাজেট বরাদ্দ ও সহায়ক জনবলের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রস্তাবিত সার্ভিসের দুটি ইউনিট থাকবে— (ক) অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাটর্নি জেনারেল, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এবং অ্যাডিশনাল অ্যাটর্নি জেনারেল সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিম কোর্ট ইউনিট এবং (খ) অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি, ডেপুটি ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি, অ্যাডিশনাল ডিস্ট্রিক্ট এবং ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি সমন্বয়ে গঠিত জেলা ইউনিট।

ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থা এবং স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠন প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক। সংস্কার কমিশনের এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যতিক্রম, যেখানে ল ক্যাডার সার্ভিস নেই। ক্ষমতাসীন দল বদল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল থেকে শুরু করে আইন কর্মকর্তা ও পিপি-এপিপি পদে রদবদল হয়ে যায়। নতুন ক্ষমতাসীন দলের অনুসারীরা ওই সব পদে নিয়োগ পান। এতে দক্ষতা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ঘাটতি দেখা যায়।

শাহদীন মালিক বলেন, পুলিশকে বহু ধরনের কাজ করতে হয়। যদি আলাদা করে একদল শুধু তদন্তের জন্য নিয়োজিত থাকে, তাহলে তাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বাড়বে। তদন্ত সঠিক ও যথার্থ হবে।