ছয় বছর আগে চট্টগ্রাম নগরে এক হাজার ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হন এক রোহিঙ্গা যুবক। নিজের নাম-ঠিকানা গোপন রেখে দেন অন্যেরটি, যাতে জামিনে গেলে গ্রেপ্তার ও সাজা এড়ানো যায়।
ইতিমধ্যে জামিনে বেরিয়ে পলাতক হয়ে যান সেই আসামি। পরোয়ানা জারি হলে হাজির হন প্রকৃত আসামির পরিবর্তে আরেক ব্যক্তি। ছবিতে অমিল পাওয়া যায় ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার ও হাজির হওয়া ব্যক্তির মধ্যে।
আদালতের নির্দেশে ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার আসামির কারাগারে তোলা সেই ছবির সাহায্যে প্রকৃত আসামিকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
গত সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে আবুল হোসেনকে (৩৪) আসামি করে নগরের চান্দগাঁও থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দেয় সংস্থাটি। এতে বলা হয়, আগের তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা সঠিকভাবে আসামির নাম-ঠিকানা যাচাই-বাছাই না করে অন্য ব্যক্তির নামে অভিযোগপত্র দেন।
পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, আসামির কারাগারে তোলা একটি ছবির সাহায্যে তাঁকে শনাক্ত করা হয়। পরে ইয়াবাসহ গ্রেপ্তারের কথা স্বীকার করেন। মূলত গ্রেপ্তার ও সাজা থেকে বাঁচতে নিজের পরিবর্তে আরেকজনের নাম-ঠিকানা দেন রোহিঙ্গা আবুল হোসেন।
আদালত সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর নগরের কালুরঘাট ব্রিজ-সংলগ্ন এলাকা থেকে এক হাজার ইয়াবাসহ এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে চান্দগাঁও থানার পুলিশ। তিনি নিজেকে পরিচয় দেন সালাউদ্দিন (২৮) নামে, বাবা মমতাজ আহমদ, বাড়ি চকরিয়া। অথচ তাঁর নাম আবুল হোসেন, তিনি কক্সবাজারের উখিয়া বালুখালী রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প-১২ বাসিন্দা আলী জোহারের ছেলে। এ ঘটনায় ওই থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়। পরে মামলাটি তদন্ত শেষ করে একই বছরের ১৮ নভেম্বর আদালতে সালাউদ্দিনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেন চান্দগাঁও থানার তৎকালীন এসআই এ এফ এম জিয়াউল হুদা।
জানতে চাইলে এ এফ এম জিয়াউল হুদা বলেন, ‘মাদক মামলায় আসামি গ্রেপ্তার থাকায় ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিয়ে দিতে হয়। চকরিয়া থানা থেকে ইএস স্লিপ না পাওয়ায় আসামির দেওয়া তথ্যমতে অভিযোগপত্র দিয়েছি। পরে আদালতের মাধ্যমে জানতে পারলাম, ওই ঠিকানা ভুয়া।’
এদিকে ২০১৮ সালের ২৯ নভেম্বর কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে যান সালাউদ্দিন পরিচয়ে ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হওয়া আসামি আবুল হোসেন। পলাতক হওয়ায় আদালত আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। বিষয়টি জানতে পারেন পেশায় কৃষক সালাউদ্দিন। ২০২১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর চতুর্থ অতিরিক্ত চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতে হাজির হন। সেখানে মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ চলছিল। সালাউদ্দিনের আইনজীবী সুহার্ত খাস্তগীর আদালতে লিখিত আবেদনে উল্লেখ করেন, সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। তিনি কখনো গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যাননি।
রাষ্ট্রপক্ষের তৎকালীন কৌঁসুলি অনুপম চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, আদালত তাৎক্ষণিকভাবে চট্টগ্রাম কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ককে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেন। তাঁরা কারা নিবন্ধনে থাকা ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার আসামির ছবি ও তথ্য পাঠান আদালতে। আদালত ওই ছবির সঙ্গে পরোয়ানা যাওয়া সালাউদ্দিনের চেহারার মিল পাননি। ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার প্রকৃত আসামিকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন আদালত। সালাউদ্দিনকে মুক্তি দেন।
ছবিই ধরিয়ে দেয় প্রকৃত আসামি
আদালতের নির্দেশের পর পিবিআই তিনজন তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রকৃত আসামি আবুল হোসেনের হদিস পাননি। চতুর্থ তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিদর্শক মোজাম্মেল হক ইয়াবাসহ গ্রেপ্তারের পর কারাগারে যাওয়া আসামির প্রকৃত পরিচয় বের করেন। আবুল হোসেন যে সময় কারাগারে ছিলেন, ওই সময়ের কয়েকজন বন্দী, যাঁরা বর্তমানে জামিনে রয়েছেন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। মোটামুটি ধারণা পান, আবুল হোসেন রোহিঙ্গা। ইতিমধ্যে ঘটনার শিকার কৃষক সালাউদ্দিনও জানান, তাঁদের এলাকায় কৃষিকাজ করতে আসা কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে তাঁর কথা-কাটাকাটি হয়েছিল। ছবির ব্যক্তির সঙ্গে এক শ্রমিকের চেহারার মিল রয়েছে। আবুল হোসেনের পূর্বপরিচিত স্থানীয় নুরুল হুদাও জানিয়েছেন, ছবির ব্যক্তি শ্রমিক আবুল হোসেন। উখিয়া ক্যাম্পে থাকেন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো তৎকালীন পরিদর্শক মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, উখিয়া ক্যাম্পে গিয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়, ছবির ব্যক্তি আবুল হোসেন। এরপর তাঁকে ধরতে বেশ কয়েকবার অভিযান চালানো হয়, কিন্তু পাওয়া যায়নি। পরে চলতি বছরের ২৩ মার্চ গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর সব স্বীকার করেন তিনি। পরে গত অক্টোবর মাসের শেষের দিকে তাঁকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। অব্যাহতি পান নিরীহ ব্যক্তি সালাউদ্দিন। মামলাটি অভিযোগপত্র গ্রহণের শুনানির জন্য রয়েছে। জামিনে আছেন আবুল হোসেন।
কৃষক সালাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসামির একটি ছবিই আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। কারাগার থেকে সেটি আদালতে উপস্থাপন না করলে অপরাধী না হয়েও কারাভোগ করতে হতো। পুলিশ কর্মকর্তা সঠিকভাবে তদন্ত করলে আমাকে এত ভোগান্তি পোহাতে হতো না।’