জানা-অজানা অনেক নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধের রক্তস্রোতে ভিজে আছে এই সবুজ বাংলাদেশ। পাকিস্তানের সশস্ত্র হানাদার সৈন্যদের পৈশাচিকতায় তাঁরা শহীদ হন। তাঁদের অনেকে ওই খুনে জল্লাদদের হত্যার উন্মত্তার নিষ্ঠুর শিকার হয়েছিলেন, আবার অনেক বীর সন্তান তাঁদের প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন প্রিয় মাতৃভূমিকে পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করতে। তাঁদের তেমন কোনো সামরিক প্রশিক্ষণ, প্রস্তুতি ও আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র ছিল না। তবু বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণি-পেশার মানুষ পাকিস্তানি হানাদারদের প্রতিহত করতে একাত্তরে ছুটে গিয়েছিলেন যুদ্ধের ময়দানে।
বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করেন এমন অনেকে ছিলেন তাঁদের মধ্যে। বহুজন শহীদ হয়েছেন। হানাদার পাকিস্তানিরা তাদের পরাজয় নিশ্চিত জেনে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করেছিল। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের প্রাক্কালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের হাতে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন স্বনামধন্য শিক্ষক, বিজ্ঞানী, চিন্তক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিল্পী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, আইনজীবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সরকারি-বেসরকারি পদস্থ কর্মকর্তাসহ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা।
স্বাধীনতার পর বিভিন্ন বধ্যভূমি ও গণকবরে তাঁদের দেহাবশেষ পাওয়া যায়। মাতৃভূমির জন্য প্রাণ বিসর্জন দেওয়া জাতির এ শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মৃতির প্রতি সম্মান ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। তবে এ দিনটি ছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে নিয়োজিত অনেক মানুষ নানাভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার শিকার হয়েছেন। আত্মদান করেছেন। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও তাঁদের অনেকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি। এ নিয়ে তাঁদের পরিবারের সদস্য, স্বজন ও সুহৃদদের মধ্যে প্রিয়জন হারানোর শোকের পাশাপাশি প্রবল বঞ্চনার বেদনাও রয়েছে।
গত বছর থেকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। মন্ত্রণালয় এ পর্যন্ত দুই দফায় ২৩৩ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীকে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করেছে। সরকারের এই উদ্যোগকে শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সন্তান-স্বজনেরা স্বাগত জানিয়েছেন। তবে অনেকে এখনো স্বীকৃতি পাননি। বাকি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নামের তালিকা দ্রুত প্রকাশের দাবি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তান ও স্বজনদের।
‘দেশের মাটিতে কি বাবার কবর হবে না’
কথা হচ্ছিল উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীর কালমাটি গ্রামের ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান তালুকদারের সঙ্গে। তিনি এখন ঢাকায় থাকেন। জানালেন, বহু প্রতীক্ষার পর তাঁর বাবা কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক মো. আবদুল ওয়াহাব তালুকদারের নাম চলতি বছর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত গেজেটে শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এটা তাঁদের পরিবারের কাছে একটি বড় সান্ত্বনা। তবে আরেকটি প্রত্যাশা আছে। ভারতে থাকা তাঁর বাবা আবদুল ওয়াহাবের দেহাবশেষ দেশে নিয়ে আসা। তিনি বলছিলেন, ‘যে দেশের জন্য বাবা প্রাণ দিলেন, সে মাটিতে কি তাঁর কবর হবে না?’
বাবার শহীদ হওয়ার স্মৃতিচারণা করে মিজানুর প্রথম আলোকে বললেন, তাঁর বাবা আবদুল ওয়াহাবের জন্ম ১৯৪৩ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দিনহাটা মহকুমার কালমাটি গ্রামে। দেশভাগের পর তাঁদের পরিবার সীমান্তের এপারে ভূরুঙ্গামারীর সিংঝর গ্রামে বসবাস শুরু করে। ১৯৬৪ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন।
তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশপ্রেমিক মানুষ। একাত্তরের মার্চে বঙ্গবন্ধুর ডাকে উদ্বুদ্ধ হয়ে সহপাঠী ও ছাত্রদের সংগঠিত করেন। পরিস্থিতি উত্তাল হয়ে উঠলে তিনি কুড়িগ্রাম ছেড়ে তাঁর গ্রাম ভূরুঙ্গামারীতে চলে যান। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তিনি পরিবারের সদস্য ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে ভারতের কালমাটি গ্রামে চলে যান। সেখানে তিনি ৬ নম্বর সেক্টরের বামনহাটি যুবক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেন। এরপর ক্যাম্পের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পান। যুদ্ধের একপর্যায়ে ৭ আগস্ট তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় সীমান্ত পার হয়ে ভূরুঙ্গামারীর সিংঝর গ্রামে আসেন। বিকেলে তাঁরা রেললাইনের পাশের একটি জঙ্গলে যুদ্ধের পরিকল্পনা করছিলেন। তখন হানাদারেরা তাঁদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে ছুটতে থাকেন। হানাদারেরা গুলি চালালে আবদুল ওয়াহাব পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যান। ঘাতকেরা তাঁকে ধরে ফেলে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে পাশের ডোবায় লাশ ফেলে যায়।
মিজানুর রহমান বললেন, ঘাতকেরা চলে গেলে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর বাবার মরদেহ সেই ডোবা থেকে তুলে আনেন। বৈরী পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশে দাফনের অবস্থা ছিল না। বগনী নদীর কিনারে কালমাটি মসজিদের পাশেই তাঁকে দাফন করা হয়। মিজান জানান, তখন তাঁর বয়স ছিল পাঁচ বছরের মতো। দাফনের আগে তিনি বাবাকে দেখতে গিয়েছিলেন। তবে বাবার মুখটি তাঁর এখন স্পষ্ট মনে পড়ে না। শুধু মনে আছে, সেখানে অনেক মানুষ এসেছিলেন। তাঁরা কান্না করছিলেন।
মিজানুর রহমানেরা তিন ভাই। মেজ ভাই মোখলেসুর রহমানের বয়স ছিল তখন তিন বছর। তিনিও এখন ঢাকায় চাকরি করেন। ছোট ভাই ব্যবসায়ী মাহবুবুর রশীদ গ্রামের বাড়িতেই থাকেন। তাঁদের মা বয়োবৃদ্ধ। তাঁরা গ্রামে বাবার স্মৃতিরক্ষায় ‘শহীদ আবদুল ওয়াহাব পাঠাগার’, ‘শহীদ আবদুল ওয়াহাব আদর্শ যুবসংঘ’, ‘শহীদ আবদুল ওয়াহাব কিন্ডারগার্টেন স্কুল’ গড়ে তুলেছেন। এ ছাড়া কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের ছাত্রাবাসের নামকরণ করা হয়েছে ‘শহীদ ওয়াহাব ছাত্রাবাস’।
মিজান জানালেন, প্রথম আলোতে তাঁর বাবা আবদুল ওয়াহাবকে নিয়ে একাধিকবার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ২০১৮ সালে তাঁরা আবেদন করেছেন বাবার দেহাবশেষ দেশে আনার জন্য। মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে।
শহীদ আবদুল ওয়াহাবের পরিবারের মনে হয়, যে দেশের জন্য তিনি জীবন উৎসর্গ করেছেন, সেই দেশের মাটিতেই যদি তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হতে না পারেন, তা বড়ই বেদনাদায়ক।
অবশেষে স্বীকৃতি পেলেন প্রিয় সাধন
ময়মনসিংহের ফুলপুরের পয়ারী গ্রামের শহীদ বুদ্ধিজীবী প্রিয় সাধন সরকার ছিলেন বহুগুণের অধিকারী। শিক্ষক, তারুণ্যে টগবগে কবি ও নাট্যকার। একাত্তরের প্রথম পর্যায় থেকেই তিনি মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গোপনে সভা করছিলেন। সেখান থেকেই তাঁকে ধরে নিয়ে যায় ঘাতক হানাদার সেনারা।
সাধন সরকারের ছেলে তাপস সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করে এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পদে কর্মরত। তাপস সরকার প্রথম আলোক বলেন, বাবার কোনো স্মৃতি এখন তাঁর মনে নেই। তাঁরা দুই ভাইবোন। যখন বাবাকে হত্যা করা হয়, তখন তাঁর বয়স ছিল প্রায় দেড় বছর আর ছোট বোন কাকলি সরকারের বয়স দুই মাস। কাকলি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন। এখন গৃহবধূ। মা মঞ্জুলা সরকার এখন ঢাকায় ছেলের সঙ্গে থাকেন। তাঁরা কোনো সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা পাননি। মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ৫১ বছর পর চলতি বছর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের গেজেটে তাঁর বাবা প্রিয় সাধন সরকারের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, এটা তাঁদের জন্য খুবই আনন্দের।
গত বছর প্রথম আলোতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিচিতি তুলে ধরে ধারাবাহিক প্রতিবেদনে প্রিয় সাধন সরকারের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের কথা তুলে ধরা হয়েছিল। তাপস সরকার এ জন্য প্রথম আলোকেও ধন্যবাদ জানালেন।
সাধন সরকারের জন্ম ১৯৪২ সালে। শৈশব থেকেই কবিতা ও নাটক লিখতেন। আনন্দমোহন কলেজ থেকে ১৯৬৩ সালে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে বিএড প্রশিক্ষণ নেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন তাঁর গ্রামের পয়ারী গোকুল চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক। তরুণ শিক্ষক প্রিয় সাধন ছাত্রদের বাঙালিত্বের চেতনা ও সংস্কৃতিচর্চায় উৎসাহিত করতেন। হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে শহর থেকে পালিয়ে আসা লোকেদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন। অর্থ ও অন্যান্য ভাবে সাহায্য তিনি করছিলেন তাঁদের। সাধন সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন সভায় গিয়ে খবরাখবর দিতেন। একাত্তরের ১৯ জুলাই এমনই এক সভায় ছিলেন তিনি। হানাদারেরা সেখানে হামলা চালিয়ে সাধনসহ ছয়জনকে আটক করে। পরে ফুলপুরের কংস নদের তীরে তাঁদের গুলি করে হত্যা করা হয়।
শহীদ বুদ্ধিজীবী সাধনের ছেলে তাপস বললেন, তাঁর মায়ের বয়স তখন মাত্র ২১ বছর। তিনি উচ্চমাধ্যমিক পাস ছিলেন। স্বাধীনতার পর সংসার চালাতে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন। পাশাপাশি নিজেও পড়ালেখা শুরু করেন। তাঁর মা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন। তাঁদের দুই ভাইবোনকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন।
তাপস বলেন, শহীদ পরিবারের ক্ষেত্রে দেখা যায়, পরিবারের প্রধান ব্যক্তি শহীদ হওয়ার পরে তাঁদের স্ত্রীরা সংসারের হাল ধরেছেন। টিকে থাকার কঠিন সংগ্রাম করেছেন। এই সংগ্রামী মানুষদের সম্মান জানিয়ে সরকারিভাবে যদি তাঁদের একটি আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনার ব্যবস্থা করা হতো, তবে তাঁরা আরও আনন্দিত হতেন।
‘আব্বা দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন, এটি আমাদের গর্ব’
শহীদ এমলাক হোসেন ছিলেন মেহেরপুর জেলার গাংনীর সাহারবাটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তাঁর জন্ম ১৯২০ সালে ভারতের নদীয়ার গোয়াস-রহমতপুর গ্রামে। দেশভাগের পর তাঁর পরিবার সাহারবাটিতে বসবাস শুরু করে। কুষ্টিয়ার কাথুলি এন এস বিদ্যামন্দির থেকে ম্যাট্রিকুলেশন করে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন। গাংনীর সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও ছিলেন পুরোধা ব্যক্তিত্ব। নাটকে অভিনয় করতেন। মেতে থাকতেন রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-আব্বাস উদ্দীনের গানে। পাকিস্তান আমলে সামরিক শাসনের মধ্যেও নিজ বাড়ির আঙিনায় ও স্কুল মাঠে উদ্যাপন করতেন পয়লা বৈশাখ, রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তী।
শহীদ বুদ্ধিজীবী এমলাক হোসেনের মেজ ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা পড়াশোনা করেছেন ঢাকা চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে। মেহেরপুর জেলা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার। তিনি দীর্ঘদিন সাহারবাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। প্রথম আলোর মেহেরপুর প্রতিনিধি, আবু সাঈদের কাছে বাবার স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, পাকিস্তানি শাসকদের অত্যাচার নিপীড়ন লাগামহীন হয়ে পড়লে তাঁর বাবা স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন। মুক্তিকামী মানুষদের যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। তাঁদের তিন ভাইকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে পাঠান। দেশে থেকে তাঁর বাবা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, আর্থিক সহযোগিতা ও সেক্টর কমান্ডারদের সঙ্গে যোগাযোগ করার কাজ করতেন। মেহেরপুরে প্রতিরোধযুদ্ধের সূচনালগ্নে গাংনী থানার বন্দুক মালিকদের সহযোগিতায় তাঁর নেতৃত্বে বন্দুক বাহিনী গড়ে ওঠে। এ কারণে স্থানীয় রাজাকারেরা পাকিস্তানি সেনাদের ডেকে এনে তাঁকে ধরিয়ে দেয়।
গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘নদীয়াতে আমরা তিন ভাই মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলাম। এমন সময় খবর পাই, হানাদার সেনারা আব্বাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করে লাশ কাজলা নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে। তাঁর লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিই। আব্বা দেশের মুক্তির জন্য জীবন দিয়েছেন, এটি আমাদের সবচেয়ে গর্বের বিষয়। তবে আব্বা এখনো শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি পাননি, এটা আমাদের জন্য খুবই মর্মবেদনার কারণ হয়ে আছে।’
এমলাক হোসেনসহ অন্য শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে ভাটপাড়ায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। তাঁর স্ত্রী মেহের আফরোজ ও তাঁদের আট সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে মারা গেছেন। অপর ছয় ছেলে ও এক মেয়ে বেঁচে আছেন। তাঁরা সবাই শিক্ষিত, শিল্প-সংস্কৃতির অনুরাগী ও সরকারি চাকুরে।
‘বাবার স্বীকৃতির আশায় থেকে মা চলে গেলেন’
শহীদ বাগ্মীশ্বর বড়ুয়ার বড় মেয়ে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার উরকিরচর ইউনিয়নের মইশকরম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শুভ্রা বড়ুয়া। তিনি বললেন, তাঁর বাবার নাম শহীদ বুদ্ধিজীবীর সরকারি তালিকায় ওঠেনি। যতবার নতুন করে সরকারি তালিকাভুক্তির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, প্রতিবারই কাগজপত্র জমা দিয়ে পরিবার থেকে আবেদন করা হয়েছে, কিন্তু কিছুই হয়নি। বাবার সরকারি স্বীকৃতির আশায় থেকে তাঁর বৃদ্ধা মা সাবেক শিক্ষক সবিতা রাণী বড়ুয়া গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে মারা গেছেন। তাঁরা পাঁচ ভাইবোন। তাঁদের বাবা সরকারিভাবে শহীদ বুদ্ধিজীবীর স্বীকৃতি পাবেন, এটাই তাঁদের প্রত্যাশা।
বাগ্মীশ্বর বড়ুয়া ছিলেন রাঙ্গামাটির কাপ্তাই কর্ণফুলী প্রকল্প উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক। একাত্তরের ১৩ জুন রাজাকারদের নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার সেনারা স্কুলের সামনে থেকে বাগ্মীশ্বর বড়ুয়াকে তুলে নিয়ে হত্যা করে। তাঁর লাশ পাওয়া যায়নি।
শুভ্রা বড়ুয়া প্রথম আলোর রাউজান প্রতিনিধি এস এম ইউসুফ উদ্দিনকে বলেন, পাকিস্তানি বর্বর সেনারা একাত্তরের ১২ এপ্রিল কাপ্তাই প্রবেশ করে ক্যাম্প করে। তাঁর বাবা বাগ্মীশ্বর বড়ুয়া পরিবারকে নিরাপদে রাখার জন্য ২০ মে গ্রামের বাড়ি রাউজানের উরকিরচর ইউনিয়নের আবুরখিলে চলে আসেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই তরুণদের যুদ্ধে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করতেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করতেন। গ্রামে এসেও তিনি এলাকার তরুণদের নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দল গড়ে তোলেন। একপর্যায়ে তিনি পরিবার গ্রামে রেখে ১৩ জুন কর্মস্থল কাপ্তাই ফিরে আসেন। স্কুল এলাকায় তাঁর আসার খবর পেয়েই স্থানীয় রাজাকারেরা পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তাঁকে তুলে দেয়।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাগ্মীশ্বর বড়ুয়ার স্ত্রী শিক্ষক সবিতা রাণী বড়ুয়ার কাছে সমবেদনা জানিয়ে একটি চিঠি ও অনুদান হিসেবে দুই হাজার টাকার চেক পাঠিয়েছিলেন। এ ছাড়া কাপ্তাই উপজেলায় তাঁর নামে একটি সড়ক আছে। তাঁর কর্মস্থল কাপ্তাই বিদ্যুৎ প্রকল্পের মূল ফটকে শহীদের নামের তালিকায় বাগ্মীশ্বরের নাম আছে। গত বছর প্রথম আলোয় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে প্রকাশিত ‘বীরের এ রক্তস্রোত’ শীর্ষক ধারাবাহিক প্রতিবেদনেও তাঁর জীবন ও সংগ্রামের কথা প্রকাশিত হয়েছিল।
শহীদ বাগ্মীশ্বর বড়ুয়ার জন্ম ১৯১৭ সালে। ১৯৬১ সালে ঢাকা সিটি কলেজ থেকে বিএড পাস করেন। পালি ভাষায় বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন তিনি। এ জন্য ‘পালি সূত্র বিশারদ’ উপাধিও পেয়েছিলেন। বৌদ্ধধর্ম নিয়ে তাঁর লেখা ‘বিমুক্তি রূপায়ণে বৌদ্ধ ধর্ম’ বইটি পাঠকমহলে বেশ প্রশংসিত হয়েছিল।
বাগ্মীশ্বর বড়ুয়া ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অগ্রনায়ক মাস্টারদা সূর্য সেনের অনুসারী ছিলেন। কিশোর বয়সে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকায় ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে আটক করে নির্যাতন করেছিল। কর্মজীবনে শহীদ বাগ্মীশ্বর বড়ুয়া চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকতা ও চট্টগ্রাম রেঞ্জের স্কুল পরিদর্শক হিসেবেও কাজ করেছেন। সর্বশেষ কাপ্তাই প্রকল্প উচ্চবিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধের অর্ধশতাব্দীর অধিক কাল কেটে গেছে। শহীদ বাগ্মীশ্বর বড়ুয়ার স্ত্রীর মতো শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্ত্রী, সন্তান ও পরিবারের অনেক সদস্য প্রতীক্ষায় থেকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তাঁরা জেনে যেতে পারেননি যে তাঁদের প্রাণাধিক প্রিয় মানুষটির আত্মদানের স্বীকৃতি এই রাষ্ট্র দিয়েছে কি না। আর শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের যাঁরা জীবিত, তাঁদের একটাই প্রত্যাশা যে দেশের জন্য শহীদ বুদ্ধিজীবীরা প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের স্বীকৃতি যেন তাঁরা দেখে যেতে পারেন।