ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ
ডব্লিউএইচওর পরামর্শ শোনেনি সরকার
মৌসুম শুরুর আগেই ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। বর্ষা শুরু হলে আরও বৃদ্ধির ঝুঁকি আছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পরামর্শক কে কে কৃষ্ণমূর্তি ২০১৭ সালে সরকারকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে বলেছিলেন। সরকার সেই উদ্যোগ নেয়নি। দুই বছর পর ২০১৯ সালে ওই সংস্থার জ্যেষ্ঠ কীটতত্ত্ববিদ বি এন নাগপাল ডেঙ্গুর জীবাণু বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সরকারকে সুনির্দিষ্ট কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন। সরকার সেই পরামর্শও সব কটি শোনেনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ২০০০ সালের পর থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কাজ করছে অস্থায়ী ভিত্তিতে, সমস্যার আপাত সমাধান করতে। তাদের কাজে কোনো সমন্বয় নেই। এই পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু এখন সারা দেশের রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এর আগে ডেঙ্গু মূলত ঢাকা শহরের রোগ ছিল। চট্টগ্রাম, খুলনার মতো বড় শহরে অতীতে কিছু ডেঙ্গু রোগী দেখা গেছে। কিন্তু গত বছর দেশের ৫০টির বেশি জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়েছিল। এ বছর ডেঙ্গুর মৌসুম এখনো শুরু হয়নি, এরই মধ্যে ৪৪টি জেলায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে এবং চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন রোগীরা। জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, ডেঙ্গুর জীবাণু ও জীবাণু বাহক মশা সারা দেশেই আছে। ডেঙ্গু এখন সারা দেশের মানুষের জন্য ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে
ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব প্রথম বড় আকারে দেখা দেয় ২০০০ সালে। দেশের মানুষ, চিকিৎসক সমাজ ও সরকার এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। সরকারি হিসাবে ওই বছর ৫ হাজার ৫৫১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন এবং ৯৩ জন মারা যান। সেই থেকে নিয়মিতভাবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে থাকে। তবে ২০০৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। মৃত্যু সবচেয়ে বেশি হয় গত বছর। সংখ্যাটি ছিল ২৮১।
অ্যাডহক (অস্থায়ী) ভিত্তিতে বা ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে কাজ করে এডিস মশা ও ডেঙ্গু নির্মূল এবং নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। সরকার দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ শুনলে ডেঙ্গুর ঝুঁকি কমবে।অধ্যাপক বে-নজীর আহমেদ, জনস্বাস্থ্যবিদ
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরের চেয়ে এ বছরের পরিস্থিতি খারাপ। গত বছরের প্রথম পাঁচ মাসে অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩৫২ জন। কোনো মৃত্যু ছিল না। এ বছর এখনো পাঁচ মাস পূরণ হয়নি, এরই মধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৪৮৭ জন এবং মারা গেছেন ১৩ জন। যদিও ডেঙ্গুর মৌসুম শুরুই হয়নি। বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, গতকাল মঙ্গলবার সকাল আটটা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪৬ জন। এর মধ্যে ৪১ জন ঢাকার।
জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজীর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় কীটতত্ত্ববিদ দরকার, পরীক্ষাগার দরকার। সারা দেশে তা নেই। মশা নিধনে যে কীটনাশক ব্যবহার করা হয়, তার মান নিয়ে প্রশ্ন ছিল সব সময়। তৃতীয়ত, যে পদ্ধতিতে দেশে মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলে, তা বৈজ্ঞানিকভাবে কার্যকর এমন নিদর্শন তৈরি হয়নি। তিনি আরও বলেন, সারা দেশে মশার সঙ্গে ডেঙ্গুর জীবাণু ছড়িয়েছে। মশা ও ডেঙ্গু দুই-ই নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়েছে।
স্বাস্থ্য বিভাগ কী করছে
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা থেকে জানানো হয়েছে, এডিস মশার সংখ্যা-পরিমাণ কেমন এবং কোথায় তাদের পরিমাণ বেশি, তা জানার জন্য এ মাসের শেষের দিকে তারা একটি জরিপ করবে। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমের শুরুতে তারা এই জরিপ করে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির উপকর্মসূচি ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ একরামুল হক বলেন, আগামীকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার সব সরকারি হাসপাতালের পরিচালকদের অধিদপ্তরে অনুষ্ঠেয় সভায় ডাকা হয়েছে। ওই সভায় ডেঙ্গু চিকিৎসা ও ব্যবস্থায় হাসপাতালগুলোর প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা হবে।
অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সারা দেশের চিকিৎসকদের অনলাইনে ডেঙ্গু চিকিৎসা নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া চিকিৎসকদের ঢাকায় এনেও প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা কার্যক্রম, অভিযান ও মশকনিধন কার্যক্রম চালাচ্ছে। অবশ্য তা খুব একটা কার্যকর হচ্ছে না। দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কার্যকর উদ্যোগ আরও কম।
পরামর্শ কী ছিল
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা একরামুল হক বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অন্যান্য কীটপতঙ্গের মতো এডিস মশার টিকে থাকার সহায়ক পরিবেশ বিরাজমান। এডিস মশা বা ডেঙ্গু নির্মূল তাই কঠিন ও দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। তবে সরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার পথে যাচ্ছে।
২০১৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শক কে কে কৃষ্ণমূর্তি সরকারকে ২২ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন দিয়েছিলেন। তাতে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে করণীয় বলা ছিল। পাশাপাশি ২০টির বেশি সুপারিশ ছিল। ১২টি মন্ত্রণালয়ের পৃথকভাবে সুনির্দিষ্ট করণীয় তাতে উল্লেখ ছিল। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকে কীভাবে যুক্ত বা ব্যবহার করতে হবে, সেই পরামর্শও তাতে ছিল। এসব সুপারিশ বা পরামর্শ ২০১৯ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করার কথা ছিল।
করোনা মহামারি শুরুর আগে ২০১৯ সালে দেশে ব্যাপকভাবে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে। তখন সরকারকে পরামর্শ দিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ কীটতত্ত্ববিদ বি এন নাগপালকে। তিনি এডিস মশার চরিত্র-বৈশিষ্ট্য এবং এই মশা মারার উপায় নিয়ে একাধিক সভায় বক্তব্য দেন। সাধারণ মানুষকে তথ্য জানানো খুবই প্রয়োজন মন্তব্য করে তিনি বলেছিলেন, নির্মাণ প্রকল্প এলাকায় একসঙ্গে অনেক মানুষ কাজ করেন। আক্রান্ত শ্রমিকদের মাধ্যমে দ্রুত ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে। নির্মাণ প্রকল্প এলাকার মশার প্রজননক্ষেত্রগুলো বিনাশ করা সম্ভব হলে ডেঙ্গু ৪০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব।
জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজীর আহমেদ বলেন, অ্যাডহক (অস্থায়ী) ভিত্তিতে বা ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে কাজ করে এডিস মশা ও ডেঙ্গু নির্মূল এবং নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। সরকার দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ শুনলে ডেঙ্গুর ঝুঁকি কমবে।