সরকারি ডে-কেয়ারে শিশুসন্তানকে হারালেন, বিচার পাবেন কি না জানেন না
রাজধানীর আজিমপুর ডে–কেয়ার সেন্টারে চার মাস আগে বালতির পানিতে ডুবে শিশু উম্মে আলিফা (১১ মাস) মারা যায়। তার মৃত্যুর পর মামলা হলেও এতে কোনো অগ্রগতি নেই। উল্টো ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের লোকজন মামলা তুলে নিতে নানাভাবে হুমকি দিচ্ছেন বলে আলিফার বাবা হাকিবুল হাসান তালুকদার এবং মা ইসমত আরা তালুকদার অভিযোগ করেছেন।
গত ২৮ এপ্রিল আলিফার বাবা–মা প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে জানালেন, মামলার আসামিরা জামিনে আছেন। আসামিদের পক্ষে অনেকেই ফোন দিয়ে বলছেন, মেয়ে তো আর ফিরে আসবে না। মামলা তুলে মীমাংসা করে ফেলুন। মামলা করে কোনো লাভ হবে না।
মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুদের জন্য তৈরি রাজধানীর আজিমপুর ডে–কেয়ার সেন্টার পরিচালনা করে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর। এখানে গত ২০ ডিসেম্বর আলিফা বালতির পানিতে পড়ে যায়। কেন্দ্রের দায়িত্বরত ব্যক্তিরা শিশুটিকে উদ্ধার করে প্রথমে আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে (আজিমপুর ম্যাটারনিটি হাসপাতাল নামে পরিচিত) এবং পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসকেরা জানান, আলিফাকে মৃত অবস্থাতেই হাসপাতালে আনা হয়েছে। আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের কাগজেও আলিফাকে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে বলে লেখা রয়েছে।
হাকিবুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুস্থ মেয়েকে সকালে ডে–কেয়ার সেন্টারে দিয়ে আসলাম। দুপুরে সেন্টার থেকে ফোন দিয়ে বলা হয় মেয়ে অসুস্থ। হাসপাতালে গিয়ে শুনি মেয়ে মারা গেছে। মেয়ের মাথা, মাড়িসহ বিভিন্ন জায়গায় রক্ত জমাট বেঁধে ছিল। ডে–কেয়ার থেকে শুধু বলছে, বালতির পানিতে পড়ে গিয়েছিল আলিফা। মেয়ে বালতির পানিতে পড়বে কেমনে? কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলায় আমাদের সন্তান মরে গেল। মেয়ের মৃত্যুর পর সেন্টারের কেউ আমাদের খোঁজ নেয়নি। হাসপাতাল থেকেই তাঁরা পালিয়ে যান।’
হাকিবুল হাসান বলেন, ‘আমরা এখন ভয়ে আছি। ডে–কেয়ারের কাছেই আমাদের বাসা। সেন্টারে আমার বাসার ঠিকানা দেওয়া আছে। মামলা করেছি বলে কেউ যদি প্রতিশোধ নিতে কোনো কিছু ঘটায়, আমরা তো কিছু করতেও পারব না।’
হাকিবুল হাসান-ইসমত আরা দম্পতির বড় ছেলে আল আরাবির বয়স ২ বছর ৭ মাস। প্রথমে আরাবিকে, পরে আলিফাকে রাজধানীর আজিমপুরে অফিসার্স কলোনির ক্যাম্পাসের শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়েছিল। আলিফার মৃত্যুর পর আরাবিকে এখন বাসায় রাখতে হচ্ছে। সে সারা দিন তার বোনকে খোঁজে। বাইরে গেলেই বলে, বাক্কার (বোনকে বাক্কা ডাকে) কাছে যাচ্ছে।
আলিফার মৃত্যুর পরপর আজিমপুর ডে–কেয়ার সেন্টার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আগামীকাল ২ মে থেকে আবার কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হবে।
মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত উপপরিচালক কানিজ তানিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজিমপুর শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের কার্যক্রম আবার ২ মে শুরু হবে। পুরোনো কর্মীদের বাদ দিয়ে নতুন ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনা থেকে আমরা অনেক কিছু শিক্ষা নিয়েছি। কেন্দ্রে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর প্রক্রিয়া চলছে। মামলাটিও চলমান আছে।’
২১ ডিসেম্বর হাকিবুল হাসান কর্তৃপক্ষের অবহেলায় মৃত্যু ঘটানোর অভিযোগে লালবাগ থানায় কেন্দ্রের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা রেজিনা ওয়ালিসহ সহকারী শিক্ষক, আয়া, গার্ড, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, রাঁধুনিসহ অন্যদের আসামি করে মামলা করেন।
হাকিবুল হাসান বলেন, এ ঘটনার পাঁচ মাস আগে ছেলে এবং দুই মাস আগে মেয়েকে সেন্টারটিতে ভর্তি করেছিলেন। এর আগে ছেলের পিঠে কামড়ের দাগ দেখে তাঁরা কেন্দ্রটিতে অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
হাকিবুল হাসান রাজধানীতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রকৌশলী ও ইসমত আরা তালুকদার পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের অধীনে আজিমপুরে একটি প্রতিষ্ঠানে জ্যেষ্ঠ নার্স হিসেবে কাজ করেন।
ইসমত আরা বলেন, ‘সরকারি ডে–কেয়ারে ভর্তি করে মেয়েকে হারালাম, বিচার পাব কি না, তা–ও বুঝতে পারছি না। আমরা মেয়ে হত্যার বিচার চাই।’
হাকিবুল হাসান বলেন, ‘অসুস্থতার খবর শুনে আজিমপুর ম্যাটারনিটিতে গিয়ে দেখি, মেয়েকে নিয়ে সেন্টারের লোকজন ঢাকা মেডিকেলে যাচ্ছেন। মেয়ের নাকে অক্সিজেনের নল লাগানো। মেয়ের হাত–পা বরফের মতো ঠান্ডা। আমি বলি, বাচ্চা তো নাই, ওর শরীর তো ঠান্ডা। একজন আমাকে ধমক দিয়ে বলেন, দেখেন না অক্সিজেন চলছে। বাচ্চা চান, না চিল্লাপাল্লা করবেন। আল্লাহ আল্লাহ করেন।’
হাকিবুল হাসান বলেন, ‘আজিমপুর ম্যাটারনিটি হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকা মেডিকেল নেওয়ার সময় মেয়েকে আমার কোলে দিতে বললেও সেন্টারের লোকজন দেননি। ঢাকা মেডিকেলে নিলে চিকিৎসক বলেন, আপনারা কেমন অভিভাবক, এখানে আনার আগেই বাচ্চা মারা গেছে। আগের হাসপাতালে নেওয়ার কাগজ দেখেও ওই চিকিৎসক বলেন, এখানেও তো লেখা আছে বাচ্চাকে মৃত আনা হয়েছিল।’
প্রথম আলো কার্যালয়ে হাকিবুল হাসান ও ইসমত আরা ছেলে আরাবিকে নিয়ে যখন ছবি তুলছিলেন, তখন দুজনেরই চোখ ছলছল করছিল। কয়েক মাস আগেও এই দম্পতি দুই ছেলে–মেয়েকে নিয়ে হাসিমুখে ছবি তুলতেন, আর এখন শুধু ছেলেকে নিয়ে ছবি তুলতে হচ্ছে।
আলিফার দুর্ঘটনার পর লালবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খন্দকার হেলাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ডে-কেয়ার সেন্টারের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে তিনি জানতে পেরেছেন, শিশুটি বালতিভর্তি পানিতে পড়ে মারা গেছে। শিশুটিকে উদ্ধারের সময় তার মাথা নিচে এবং পা ওপরের দিকে ছিল। এই মৃত্যুর পেছনে ডে-কেয়ার সেন্টার পরিচালনাকারীদের গাফিলতি রয়েছে।
আবৃত্তিশিল্পী ও মামলার ১ নম্বর আসামি রেজিনা ওয়ালীকে গত ২১ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার করে লালবাগ থানা–পুলিশ। পরদিন সিএমএম আদালতে তোলা হলে বিচারক জামিন নামঞ্জুর করে তাঁকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছিলেন। তাঁকে ওই ঘটনায় সাময়িক বরখাস্ত করেছে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর।
অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কেয়া খানের সই করা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কেন্দ্রের ইনচার্জ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই ওই দিন অনুপস্থিত ছিলেন। সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮–এর বিধি ২ (খ) এবং বিধি ১২ (১) অনুযায়ী কর্তব্যকাজে অবহেলার দায়ে তাঁকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো।
রেজিনাকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশের ডাক দেয় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। বিভিন্ন মহল থেকে তাঁর মুক্তির দাবি তোলা হয়। বর্তমানে রেজিনা জামিনে আছেন।
গতকাল মঙ্গলবার রেজিনা ওয়ালীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি পিআরএলে (অবসরোত্তর ছুটি) আছেন। সেদিনের দুর্ঘটনা নিয়ে তাঁকে কেন ফোন করা হচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। কিছু জানার থাকলে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।
মামলার আরেক আসামি কেন্দ্রের সহকারী শিক্ষক কামরুন নাহার ওরফে মিমি ফোনে প্রথম আলোকে বলেন, এখন আর তিনি ওই কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করছেন না। এ বিষয়ে তিনি আর কোনো কথা বলতে চান না বলেই ফোন রেখে দেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা লালবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই—নিরস্ত্র) মো. রাশেদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ভিসেরা প্রতিবেদনসহ অন্যান্য প্রতিবেদন এখনো হাতে আসেনি। তবে প্রাথমিক তদন্তে আলিফার মৃত্যুতে কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলা ছিল বলেই মনে হচ্ছে।
রাশেদুল ইসলাম বলেন, মামলায় পাঁচ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আসামিরা বর্তমানে জামিনে আছেন।