মিটার বাণিজ্যে সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের ‘ভাই–বন্ধু’ চক্র
বিদ্যুৎ খাতে সাড়ে চার কোটির বেশি গ্রাহককে প্রিপেইড মিটার দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিল গত আওয়ামী লীগ সরকার। একে একে ছয়টি বিতরণ সংস্থা মিটার আমদানি করতে থাকে। এ নিয়ে কয়েক হাজার কোটি টাকা বাণিজ্যের সুযোগ তৈরি হয়। আর এ বাণিজ্যের পুরোটার নিয়ন্ত্রণ নেয় সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের ‘ভাই-বন্ধু’ চক্র।
ছয়টির মধ্যে চারটি বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার প্রিপেইড মিটার কেনার তথ্য সংগ্রহ করেছে প্রথম আলো। সংস্থাগুলোর দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও মিটার আমদানির সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা বলছেন, কিছু মিটার কেনা হয়েছে সরাসরি ক্রয়পদ্ধতি অনুসরণ করে। আর কিছু কেনা হয়েছে উন্মুক্ত দরপত্র ডেকে। তবে অভিযোগ আছে, সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী তাঁর বারিধারার বাসায় বসে ঠিকাদার চূড়ান্ত করে দিতেন। এরপর দরপত্র ডেকে কাজ দেওয়া হতো ওই ঠিকাদারের কোম্পানিকে।
প্রিপেইড মিটার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১০ সালে। মিটার সরবরাহ বাড়তে থাকে ২০২০ সালের পর। চীনের তিনটি কোম্পানি সেনজেন স্টার, হেক্সিং ও ওয়াসিয়ন গ্রুপ একটি চক্রে যুক্ত হয়ে সব মিটার সরবরাহ করে। মিটার–বাণিজ্যের নামে টাকা পাচারেরও অভিযোগ আছে এ চক্রের বিরুদ্ধে। যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধন পরিদপ্তর থেকে মিটার সরবরাহে যুক্ত একাধিক স্থানীয় কোম্পানির তথ্য সংগ্রহ করেছে প্রথম আলো। এসব কোম্পানিতে প্রতিমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া গেছে।
মিটার কেনার ক্ষেত্রে চক্রের কথা জানি। বিভিন্ন অভিযোগে প্রিপেইড মিটারে এডিবি একপর্যায়ে অর্থায়নও বন্ধ করে দিয়েছিল।মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, বিদ্যুৎ উপদেষ্টা
আগের কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই ২০১৯ সালে নেসকোতে মিটার সরবরাহের কাজ পায় ‘অকুলিন টেক’ নামের একটি কোম্পানি। চীনের সেনজেন স্টারের সঙ্গে যৌথভাবে ১০৭ কোটি টাকার এই কাজ পায় তারা। এরপর ২০২১ সালে তারা আবার নেসকোতে পায় প্রায় ৯২ কোটি টাকার কাজ। আর নেসকোতে কাজের অভিজ্ঞতা সনদ নিয়ে সবচেয়ে বড় বিতরণ সংস্থা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডে (আরইবি) মিটার সরবরাহের কাজ নেয় অকুলিন। এখানে আরও বড় বাণিজ্য করে তারা।
নেসকোর একটি দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, তাদের কাজ দিতে তৎকালীন বিদ্যুৎসচিব আহমদ কায়কাউস চাপ প্রয়োগ করেন নেসকোর বোর্ডকে। কায়কাউস পরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন, দায়িত্ব পান মুখ্য সচিবের। বর্তমানে তিনি দেশের বাইরে আছেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রিপেইড মিটার কেনার ক্ষেত্রে চক্রের কথা জানি। বিভিন্ন অভিযোগে প্রিপেইড মিটারে এডিবি (এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক) একপর্যায়ে অর্থায়নও বন্ধ করে দিয়েছিল।’ তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নেওয়া প্রিপেইড মিটারের প্রকল্পগুলো যাচাই–বাছাই করা হচ্ছে। আর কোনো চক্র তৈরির সুযোগ দেওয়া হবে না।
প্রতিযোগিতা ছিল না দরপত্রে
যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধন পরিদপ্তরের তথ্য বলছে, অকুলিন টেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হলেন শাবাদ সাজিদ। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এই কোম্পানির প্রধান কারিগরি কর্মকর্তা হিসেবে হংকং থেকে যোগ দেন কে রুম্মান আখতার। তাঁরা দুজন শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকের বন্ধু। অকুলিন মূলত মিটার ব্যবহারের প্রযুক্তিগত সহায়তা ও সফটওয়্যার সরবরাহের কাজটি নেয়। এর মাধ্যমে তারা দরপত্র নিয়ন্ত্রণ করে। এর বাইরে কেউ অংশ নিতে চাইলেও তাকে ভয় দেখিয়ে আটকানোর কাজটি করতেন নসরুল হামিদ।
নেসকোর তথ্য বলছে, সাতটি দরপত্রের মাধ্যমে মিটার সরবরাহের কাজ দেয় নেসকো। এর মধ্যে কোনো দরপত্রে দুটির বেশি কোম্পানি অংশ নেয়নি। ৪টি দরপত্রে ৫৫০ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে চীনের সেনজেন স্টার আর তিনটিতে ৪৫০ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে ওয়াসিয়ন। সেনজেন স্টারের সঙ্গে দুটিতে অংশীদার ছিল অকুলিন আর দুটিতে ছিল মিটার ডি টেক। সেনজেন স্টারের বাংলাদেশের স্থানীয় প্রতিনিধি (এজেন্ট) ছিলেন নসরুল হামিদের স্ত্রীর বড় ভাই প্রয়াত মোহাম্মদ সুজাত ইসলাম। করোনা মহামারির সময় তাঁর মৃত্যুর পর এ দায়িত্ব নেন তাঁর নিকটাত্মীয় মাহবুব রহমান ওরফে তরুণ। ওয়াসিয়নের সঙ্গে দুটিতে ছিল টেকনো ইলেকট্রিক্যাল ও একটিতে ছিল এসকিউ ট্রেডিং। এই তিন কোম্পানি এসকিউ গ্রুপের, যার মালিকানায় আছেন আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আবু জাফর মো. শফিউদ্দিন ওরফে শামীম। ওয়াসিয়নের স্থানীয় প্রতিনিধি হলো এসকিউ।
একাধিক সূত্র বলছে, বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে আলোচিত খাম্বা সরবরাহের ব্যবসায় অন্যদের সঙ্গে যুক্ত ছিল এই শামীমের কোম্পানি। ২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনে তিনি প্রথমবারের মতো নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে জয়ী হন। তিনি বর্তমানে আত্মগোপনে আছেন।
এর বাইরে কেউ অংশ নিতে চাইলেও তাকে ভয় দেখিয়ে আটকানোর কাজটি করতেন নসরুল হামিদ।
নেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মিটার কেনায় কাগজে-কলমে কোথাও কোনো অনিয়ম হয়নি। শুরুতে তিন দফায় ওরাকল সফটওয়্যারের লাইসেন্স ফি যুক্ত করে ৪১ ডলারে কেনা হলেও পরের চার দফায় ৩৫ ডলারে কেনা হয়েছে প্রতিটি মিটার।
তবে নেসকোর দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, দরপত্র জমার আগে নেসকোর প্রাক্কলিত দর প্রতিমন্ত্রীর বাছাই করা কোম্পানিকে বলে দেওয়া হতো। তাই তারাই সর্বনিম্ন দরদাতা হতো। যদিও প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রে এটি গোপন রাখার কথা। এ ছাড়া ঘুরেফিরে দুটি কোম্পানি প্রতিমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে কমবেশি দর দিয়ে কাজ ভাগাভাগি করে পেতেন। নসরুল হামিদের নির্দেশের বাইরে কেউ দরপত্র জমা দিত না।
এর সত্যতা খুঁজে পাওয়া গেছে অন্তর্বতী সরকারের সময় ডাকা দরপত্রে। নতুন করে আট লাখ মিটার কিনতে প্রথম দফায় গত ২৪ অক্টোবর দরপত্র জমা নেওয়া হয়েছে। এবার সাতটি কোম্পানি অংশ নিয়েছে। এর আগপর্যন্ত ৭টি দরপত্রের মাধ্যমে সাড়ে ১৪ লাখ মিটার সরবরাহের কাজ দিয়েছে নেসকো।
মিটার ও কমিউনিকেশন সিস্টেম সরবরাহের নামে ১ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা দর দিয়ে যৌথভাবে কাজটি পায় অকুলিন ও এসকিউ। এতে প্রতিযোগিতামূলক দামের চেয়ে অন্তত ৬১৭ কোটি টাকা বাড়তি নিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
পল্লী বিদ্যুতে মিটার কেনায় ‘হরিলুট’
মিটার–বাণিজ্যের জন্য আরইবিকে মূলত ‘টার্গেট’ করেছিল চক্রটি। ৩ কোটি ৬০ লাখের বেশি গ্রাহক আরইবির। এরা মূলত গ্রামের গ্রাহক, যাদের বিদ্যুতের ব্যবহার কম। ৮০টি সমিতির মাধ্যমে এ কাজটি করে তারা। এ পর্যন্ত ১৭ লাখ মিটার বসানো হয়েছে; আর ৫ লাখ ৬০ হাজারের কাজ চলছে। প্রকল্প করে মিটার কেনার কাজটি করে আরইবি, তারপর তা ভাগাভাগি করে বিভিন্ন সমিতিতে পাঠানো হয়। আবার সমিতির নামে দরপত্র দেয় আরইবি। ওই সমিতিকে তার অংশের বিল পরিশোধ করতে হয়। আরইবির বাড়তি দামে কেনাকাটা নিয়ে সমিতির কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ আছে। ২০২০ সালে পাঁচটি সমিতির নামে আরইবির অস্বাভাবিক দামে কেনাকাটার কিছু তথ্য প্রথম আলোর হাতে এসেছে।
আরইবির নথি যাচাই করে দেখা গেছে, আরইবি ৫ লাখ স্মার্ট প্রিপেইড মিটার কিনতে ২০২২ সালে দরপত্র আহ্বান করে। এখানেও দুটি দরপ্রস্তাব জমা পড়ে, দুটিই শামীমের সঙ্গে সম্পর্কিত। এর মধ্যে যৌথভাবে কাজ পায় অকুলিন টেক ও শামীমের এসকিউ ওয়্যার অ্যান্ড কেব্লস। দরপত্রে অংশ নেওয়া অন্য কোম্পানি ভিকার ইন্টারন্যাশনাল হলো আওয়ামী লীগের ২০০৯-২০১৪ মেয়াদে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা এনামুল হকের ভাই নাজমুল হকের।
মিটার ও কমিউনিকেশন সিস্টেম সরবরাহের নামে ১ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা দর দিয়ে যৌথভাবে কাজটি পায় অকুলিন ও এসকিউ। এতে প্রতিযোগিতামূলক দামের চেয়ে অন্তত ৬১৭ কোটি টাকা বাড়তি নিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, এ প্রকল্পের মিটার সরবরাহ এখনো শুরু হয়নি, চাইলে সরকার এটি বাতিল করতে পারে।
পুরোনো বঞ্চিত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাড়ে চার হাজার টাকার মিটারের দাম ধরা হয়েছে ৬ হাজার ২২০ টাকা। মিটারের জন্য এনআইসি কার্ডের দাম ধরা হয়েছে ৫ হাজার ২৯৫ টাকা, যেটির দাম কোনোভাবেই ২ হাজার টাকার বেশি হবে না। একটি ডেটা কনসেনট্রেটর ইউনিট (ডিসিইউ) বসাতে এক লাখ টাকা খরচ হওয়ার কথা, আরইবি কাজ দিয়েছে ৩ লাখ ১৩ হাজার টাকায়। এমন ১ হাজার ৬০০টি ডিসিইউ বসানো হয়েছে। এভাবে সবকিছুতে বাড়তি দাম ধরা হয়েছে।
এসকিউ গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক নাফিজা ইসলাম গত ৩০ অক্টোবর প্রথম আলোকে বলেন, ‘শামীম সাহেবের ভাইদের একসঙ্গে ব্যবসা আছে, আবার সবার আলাদা ব্যবসাও আছে। তবে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমেই তাঁরা কাজ পেয়েছেন।’
স্বজনদের সুবিধায় নতুন দুই কোম্পানি
মিটার উৎপাদন করে দরপত্র ছাড়াই সরাসরি সরবরাহের জন্য দুটি নতুন সরকারি কোম্পানি তৈরি করা হয় নসরুল হামিদের নির্দেশে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে বাংলাদেশ স্মার্ট ইলেকট্রিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড (বেসিকো)। বিতরণ খাতের ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) ৫১ শতাংশ ও চীনের হেক্সিং ইলেকট্রিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড ৪৯ শতাংশ শেয়ার নিয়ে বেসিকোর নিবন্ধন নেয় ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে।
হেক্সিংয়ের স্থানীয় প্রতিনিধি হলেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের বন্ধু ও রিহ্যাবের সাবেক সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামীন। দুজনই আবাসন খাতের পুরোনো ব্যবসায়ী।
বাংলাদেশ পাওয়ার ইকুইপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড (বিপিইএমসি) নামে আরও একটি কোম্পানি তৈরি করা হয় স্মার্ট প্রিপেইড মিটার তৈরির জন্য। বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতের রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল) ৫১ শতাংশ শেয়ার ও চীনের সেনজেন স্টার ইনস্ট্রুমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড ৪৯ শতাংশ শেয়ার নিয়ে এটি নিবন্ধিত হয়। সেনজেন স্টারের স্থানীয় প্রতিনিধি নসরুল হামিদের আত্মীয় মাহবুব রহমান ওরফে তরুণ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, উৎপাদনের বদলে আমদানি করে মিটার সরবরাহ করেছে ওই দুটি কোম্পানি। বাজারদরের চেয়ে বেশি আমদানি মূল্য দেখিয়ে বিদেশে টাকা পাচার করেছে তারা। দরপত্র ছাড়াই বিভিন্ন সংস্থায় সরাসরি মিটার সরবরাহের সুযোগ পেয়েছে তারা।
গত ২৯ অক্টোবর নূরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ সত্য নয়। মিটারের কারখানাটি যাতে বন্ধ না হয়, তাই কোম্পানির স্বার্থে বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
টাকা পাচারের অভিযোগ
বেসিকোর মিটার সরবরাহ কার্যক্রম নিয়ে ২০২১ সালে একটি নিরীক্ষা কার্যক্রম চালায় ওজোপাডিকো। এতে দেখা যায়, নিজেরা তৈরির কথা থাকলেও আমদানি করে মিটার সরবরাহ করেছে তারা। আর আমদানি বাণিজ্যের আড়ালে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়তি দেখিয়ে ৩৬ কোটি টাকা পাচার করেছে বেসিকো। এরপর টাকা পাচারের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে ২০২২ সালের জুলাইয়ে একটি চিঠি দেন ওজোপাডিকোর তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক (অর্থ) রতন কুমার দেবনাথ।
ওই একই সময়ে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হেক্সিংয়ের বিরুদ্ধে একটি মামলা করা হয়। এরপর ওই বছরের সেপ্টেম্বরে মামলা তুলে নিতে ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিতে নির্দেশনা দেয় ওজোপাডিকোর বোর্ড। অক্টোবরে আবেদনের পর নভেম্বরে মামলাটি প্রত্যাহার হয়ে যায়। ওই সময় বোর্ড সভাপতি ছিলেন বিদ্যুৎ বিভাগের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব নূরুল আলম। যিনি পরে জ্বালানি বিভাগের সচিব হন। টাকা পাচারের বিচার থামানোয় তিনি ভূমিকা রেখে পুরস্কৃত হয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যে তাঁকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করেছে।
গত ২৯ অক্টোবর নূরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ সত্য নয়। মিটারের কারখানাটি যাতে বন্ধ না হয়, তাই কোম্পানির স্বার্থে বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আরইবি এখন ৫ লাখ মিটারের প্রতিটিতে খরচ করছে ১২ হাজার টাকার বেশি। মিটার সরবরাহ ও স্থাপনে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা খরচ হয় বলে জানিয়েছেন এ খাতের অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীরা।
একই মিটারের বিভিন্ন দাম
ঢাকায় দুটি বিতরণ সংস্থা হচ্ছে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো)। এর মধ্যে ডেসকোর মিটার কেনার তথ্য সংগ্রহ করেছে প্রথম আলো। এতে দেখা যায়, ২০১৫ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত সরকারি টেলিফোন শিল্প সংস্থা (টিএসএস) থেকে চার লাখ মিটার কেনা হয়। সর্বশেষ সিঙ্গেল ফেজ মিটার কেনা হয় ৫ হাজার ৫০ টাকা করে। এরপর একই বছরে (২০১৯) চীনের হেক্সিং থেকে ২ লাখ মিটার কেনা হয় ২৮ ডলার করে। ওই সময় ডলারের দাম ৮৫ টাকা ধরলে মিটারের দাম ২ হাজার ৩৮০ টাকা। একই বছরে টিএসএস থেকে কেনা মিটারের দাম পড়েছে ৫ হাজার ৫৫০ টাকা।
২০২২ সালে বিপিইএমসি, টিএসএস ও বেসিকো থেকে ৭৫ হাজার মিটার কেনা হয় ৫ হাজার ২০০ টাকা করে, প্রতিটি কোম্পানি থেকে একই দামে। ২০২৩ সালে ওই তিন সংস্থা থেকে একই সংখ্যক মিটার কেনা হয় ৬ হাজার ৩০০ টাকা করে। একই দামে ২০২৪ সালে তিনটি কোম্পানিকে ৮০ হাজার করে মিটার সরবরাহের ক্রয়াদেশ দিয়েছে ডেসকো।
আরইবি এখন ৫ লাখ মিটারের প্রতিটিতে খরচ করছে ১২ হাজার টাকার বেশি। মিটার সরবরাহ ও স্থাপনে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা খরচ হয় বলে জানিয়েছেন এ খাতের অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীরা।
নিম্নমানের মিটার দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। মিটার কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত সচিব, ব্যবসায়ীসহ সবার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে, ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে।ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এম শামসুল আলম
মিটার কেলেঙ্কারির বিচার চায় ভোক্তা
গত ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদ্যুৎ খাতে মোট গ্রাহক ৪ কোটি ৭২ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ৭১ লাখ ২০ হাজার গ্রাহকের কাছে মিটার পৌঁছেছে। ২০২৫ সালের মধ্যে শতভাগ প্রিপেইড মিটার করার লক্ষ্য ছিল গত সরকারের। তবে প্রিপেইড মিটার নিয়ে গ্রাহকের মধ্যেও ক্ষোভ আছে। অনেকেই বাড়তি বিল আদায়ের অভিযোগ করেছেন বিভিন্ন সময়ে। ‘ভুতুড়ে’ বিলেরও অভিযোগ আছে। এসব মিটার এখন যাচাই করে দেখা হচ্ছে। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মিটার–বাণিজ্যের সঙ্গে সাবেক বিদ্যুৎ সচিব, সংস্থা ও কোম্পানির চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রকল্প পরিচালকেরাও যুক্ত ছিলেন। তাঁদের কেউ আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন, আবার কেউ নিয়েছেন পদোন্নতির সুবিধা।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, নিম্নমানের মিটার দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। মিটার কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত সচিব, ব্যবসায়ীসহ সবার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে, ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে।