মাঠপর্যায়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর তীব্র সংকট

জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর সংকট কাটিয়ে উঠতে পারছে না পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। মাঠকর্মীরা দম্পতিদের প্রয়োজনের সময় কনডম ও বড়ি দিতে পারছেন না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি দপ্তরগুলো বিষয়টিতে যথেষ্ট গুরুত্ব না দেওয়ায় পরিস্থিতি এই পর্যায়ে এসেছে।

গত মঙ্গলবার পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, দেশের ১০৫টি উপজেলায় কনডম নেই। খাওয়ার বড়ি নেই ৪৪৫টি উপজেলায়। এই দুটি সামগ্রী দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা রেখে এসেছে।

মাঠপর্যায়ে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর এই সংকট বহুদিন ধরে চলছে। এ বছরের ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর প্রথম পাতায় জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর সংকট নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। তখন সরকারি কর্মকর্তারা বলেছিলেন, পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, খুব দ্রুত সংকট দূর হবে। বাস্তবে তা হয়নি।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, দেশের ১০৫টি উপজেলায় কনডম নেই। খাওয়ার বড়ি নেই ৪৪৫টি উপজেলায়। এই দুটি সামগ্রী দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা রেখে এসেছে।

মঙ্গলবার পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. সাইফুল্লাহিল আজম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে যাঁরা দায়িত্ব ছিলেন, তাঁরা সংকট দূর করে যাননি। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি সংকট কাটানোর।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাঠকর্মীরা সাধারণত পাঁচ ধরনের জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী দম্পতিদের মধ্যে বিলি করেন। এগুলো হলো কনডম, খাওয়ার বড়ি, আইইউডি, ইনজেক্টেবলস ও ইমপ্ল্যান্ট। কনডম ছাড়া বাকি সামগ্রীগুলো নারীদের ব্যবহারের জন্য। সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় কনডম ও বড়ি। অধিদপ্তরের দেওয়া হিসাবে প্রতি মাসে মাঠকর্মীরা ৫০ লাখ ৩৫ হাজার কনডম ও ৩৮ লাখ ৫৫ হাজার সাইকেল বড়ি দম্পতিদের কাছে পৌঁছে দেন।

আগে যাঁরা দায়িত্ব ছিলেন, তাঁরা সংকট দূর করে যাননি। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি সংকট কাটানোর
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. সাইফুল্লাহিল আজম

সরকারি ও বেসরকারি সূত্রে জানা গেছে, সার্বিকভাবে সক্ষম দম্পতিরা এখন বেসরকারি খাত থেকেই জন্মনিয়ন্ত্রণের সামগ্রী বেশি সংগ্রহ করেন। সরকারের কাছ থেকে সামগ্রী নেয় মূলত সমাজের দরিদ্র শ্রেণি।

পরিস্থিতি কী

ওয়েবসাইটে ৪৯৩টি উপজেলায় জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর তথ্য প্রতিদিন হালনাগাদ করা হয়। মঙ্গলবার দেখা গেছে, ১০৫টি উপজেলায় কনডমের মজুত শূন্য, ১৯১টি উপজেলায় মজুত শূন্য হতে যাচ্ছে, ৮৩টি উপজেলায় মজুত যা থাকার কথা তেমন নেই। কনডমের সন্তোষজনক মজুত আছে ৭২টি উপজেলায় এবং অতিরিক্ত মজুত আছে ৪২টি উপজেলায়।

দেশজুড়ে খাওয়ার বড়ির পরিস্থিতি খুবই খারাপ। ৪৪৫টি উপজেলায় মাঠকর্মীদের কাছে নারীদের হাতে দেওয়ার মতো বড়ি নেই। ৪০টি উপজেলার বড়ি শেষ হয়ে যাবে খুব শিগগির। প্রয়োজনের চেয়ে কম বড়ি মজুত আছে দুটি উপজেলায়। সন্তোষজনক পরিমাণ বড়ি আছে ছয়টি উপজেলায়। অতিরিক্ত বড়ি কোনো উপজেলায় নেই।

সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত সামগ্রী হিসেবে তৃতীয় স্থানে আছে ইনজেক্টেবল। মাসে ৬ লাখ ৮০ হাজারের বেশি ইনজেক্টেবল সরকারি পর্যায়ে ব্যবহৃত হয়। ওয়েবসাইটে দেখা যাচ্ছে, ২৫টি উপজেলায় এই সামগ্রী একটিও নেই, ১৫৫টি উপজেলায় ইনজেক্টেবলের মজুত খুব শিগগির শেষ হয়ে যাবে এবং ১৭২টি উপজেলায় প্রয়োজনের চেয়ে কম মজুত আছে।

মঙ্গলবার দেখা গেছে, ১০৫টি উপজেলায় কনডমের মজুত শূন্য, ১৯১টি উপজেলায় মজুত শূন্য হতে যাচ্ছে, ৮৩টি উপজেলায় মজুত যা থাকার কথা তেমন নেই। কনডমের সন্তোষজনক মজুত আছে ৭২টি উপজেলায় এবং অতিরিক্ত মজুত আছে ৪২টি উপজেলায়।

কেন এমন হলো

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ করার শর্তে কথা বলতে চাননি। দুজন কর্মকর্তা বলেছেন, দুটি কারণে পরিস্থিতি এমন হয়েছে।

জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে রাজস্ব বাজেট থেকে খরচ করার ক্ষমতা দেওয়া আছে। তবে গত বছর মন্ত্রণালয় সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে বাধা দেয়। ফলে প্রয়োজনের সময় রাজস্ব বাজেট ব্যবহার করতে পারেনি অধিদপ্তর। অন্যদিকে উন্নয়ন বাজেট থেকে কিনতে হলে প্রক্রিয়া শুরু করে শেষ করতে কয়েক মাস লেগে যায়।

উন্নয়ন বাজেট থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী কেনার জন্য এ বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি দরপত্র আহ্বান করা হয়। ৭ মার্চ দরপত্র মূল্যায়ন করা হয়। যোগ্য ও সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ না দিয়ে দরপত্র বাতিল করে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। এরপর বিভিন্ন পক্ষ একাধিক স্থানে অভিযোগ দেয়, হাইকোর্টে মামলা করে। সেই জট এখনো খোলেনি।

ঠিক সময়ে হাতের কাছে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী না থাকার কারণে অপরিকল্পিত গর্ভধারণ বাড়বে। ফলে মাতৃমৃত্যুও বেড়ে যাবে। ২০৩০ সালের মধ্যে অপূর্ণ চাহিদার হার ও মাতৃমৃত্যু শূন্যে নামিয়ে আনার যে আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি আছে, তা পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়বে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম

এতে ক্ষতি কী

দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় অর্থাৎ ১৯৭১ সালে দেশে মোট প্রজননের হার (টিএফআর) ছিল ৬ বা এর কাছাকাছি। অর্থাৎ ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী একজন বিবাহিত নারী গড়ে ছয়টি সন্তানের জন্ম দিতেন।

মাঠপর্যায়ে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী বিতরণের ফলে টিএফআর ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। এখন টিএফআর ২.৩।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ১০ শতাংশ দম্পতি প্রয়োজনের সময় জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী পান না। মাঠপর্যায়ে সামগ্রী না থাকার কারণে এই অপূর্ণ চাহিদার হার আরও বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে। এতে একাধিক সমস্যা হবে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঠিক সময়ে হাতের কাছে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী না থাকার কারণে অপরিকল্পিত গর্ভধারণ বাড়বে। ফলে মাতৃমৃত্যুও বেড়ে যাবে। ২০৩০ সালের মধ্যে অপূর্ণ চাহিদার হার ও মাতৃমৃত্যু শূন্যে নামিয়ে আনার যে আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি আছে, তা পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়বে।