এবার ডেঙ্গু ভয়ানক রূপ নিতে পারে
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, এবার ঢাকার ৯৮টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৫৫টিই উচ্চ ঝুঁকিতে। ডেঙ্গুর মৌসুম গত বছরের মতো দীর্ঘ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল ২০১৯ সালে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রাক্-বর্ষা জরিপের তথ্য বলছে, এবারের পরিস্থিতি ২০১৯ সালের চেয়েও কয়েক গুণ খারাপ। গত পাঁচ বছরের মধ্যে এবার ডেঙ্গু জ্বরের বাহক এডিস মশার ঘনত্ব এবং সম্ভাব্য প্রজননস্থলের সংখ্যা সর্বোচ্চ। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৯৮টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৫৫টিই ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। ২০১৯ সালে উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ওয়ার্ড ছিল ২১টি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, প্রাক্-বর্ষা জরিপ অনুযায়ী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সব এলাকাতেই ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার উপস্থিতি বেশি। এবার ডেঙ্গুর মৌসুম গত বছরের মতো দীর্ঘ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। সিটি করপোরেশনের জোরালো কার্যক্রমের পাশাপাশি নগরবাসী সচেতন না হলে পরিস্থিতি ভয়ানক রূপ নিতে পারে।
চলতি বছর গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে ৬১ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত ৯ হাজার ৮৭১ জন। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় (গত সোমবার সকাল আটটা থেকে গতকাল সকাল আটটা পর্যন্ত) চলতি বছরে এক দিনে ডেঙ্গুতে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ। এই সময়ে মারা গেছেন পাঁচজন। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬৭৮ জন। দেশে কোনো বছরের প্রথম ছয় মাসে ডেঙ্গুর এমন ভয়াবহ রূপ আর কখনো দেখা যায়নি। ২০১৯ সালে প্রথম ছয় মাসে মারা গিয়েছিলেন ৮ জন। আক্রান্ত হয়েছিলেন ২ হাজার ২০৮ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার আওতাধীন জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি বছরে তিনবার ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় মশা জরিপ করে। প্রাক্-বর্ষা, বর্ষা ও বর্ষা-পরবর্তী জরিপ। গত ১৭ জুন থেকে ২৭ জুন পর্যন্ত এবারের প্রাক্-বর্ষা জরিপ চালানো হয়েছে। ঢাকার দুই সিটির মোট ৯৮টি ওয়ার্ডের ৩ হাজার ১৪৯টি বাড়িতে জরিপ পরিচালিত হয়। প্রাক্-বর্ষা এই জরিপের ফলাফল গতকাল রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত স্বাস্থ্য ভবনের মিলনায়তনে প্রকাশ করা হয়।
সব সূচকই এবার উদ্বেগজনক
এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের সূচক ‘ব্রুটো ইনডেক্স’ নামে পরিচিত। আর কতগুলো বাড়িতে এডিস মশার উপস্থিতি রয়েছে, তা পরিমাপের সূচক হলো হাউস ইনডেক্স। প্রাক্-বর্ষা মৌসুম জরিপের এই দুই সূচকেই ডেঙ্গু পরিস্থিতির উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে।
জরিপের তথ্য তুলে ধরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, ঢাকার দুই সিটির ৯৮টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৫৫টিতেই ব্রুটো ইনডেক্স ২০-এর বেশি। এর অর্থ হচ্ছে, এসব এলাকার ১০০টির মধ্যে ২০টির বেশি পাত্রে মশা বা লার্ভা পাওয়া গেছে। গত বছর ৯৮টি ওয়ার্ডের মধ্যে মাত্র ৩টিতে ব্রুটো ইনডেক্স ২০-এর বেশি ছিল।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৪০টি এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৫৮টি ওয়ার্ডে গেছেন জরিপকারীরা। এসব ওয়ার্ডের ৩ হাজার ১৪৯টি বাড়ি পরিদর্শন করে ৫৪৯টি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। ডিএনসিসির ২৭১ এবং ডিএসসিসির ২৭৮টি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে।
ঢাকা উত্তর সিটির মগবাজার, আদাবর, মোহাম্মদপুর, মণিপুর ও উত্তর বাড্ডা এলাকায় মশার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। আর দক্ষিণ সিটির নবাবপুর, ডিস্টিলারি রোড, আজিমপুর, হাজারীবাগ, কাঁঠালবাগান ও সায়েন্স ল্যাব এলাকায় মশার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি।
এবার এডিস মশা পাওয়া গেছে এমন বাড়ির শতকরা হারও (হাউস ইনডেক্স) উদ্বেগজনক। সাধারণত কোনো ওয়ার্ডের হাউস ইনডেক্স ১০-এর বেশি হলে উদ্বেগজনক ধরা হয়। এবার ৯৮টি ওয়ার্ডের ৮০টি ওয়ার্ডেই হাউস ইনডেক্স ১০-এর বেশি পাওয়া গেছে। গত বছর হাউস ইনডেক্স ১০-এর বেশি ছিল ১৯টি ওয়ার্ডে।
জরিপ প্রকাশ অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক আহমেদুল কবির বলেন, জরিপে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। এবার মশার ঘনত্ব ২০১৯-২০ সালের থেকে অনেক বেশি। এই বছর দেরিতে বর্ষা এসেছে, দেরিতে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ডেঙ্গুর মৌসুম গত বছরের মতো দীর্ঘ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
বহুতল ভবনে এডিসের উপস্থিতি বেশি
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, এবার বহুতল ভবনে (প্রায় ৪৪ শতাংশ) এডিস মশার লার্ভা বেশি পাওয়া গেছে। এরপর সবচেয়ে বেশি লার্ভা (প্রায় ৪০ শতাংশ) পাওয়া গেছে একক বাড়ি ও নির্মাণাধীন ভবনে। এসব স্থানে পানি জমে থাকা ভেজা মেঝে, প্লাস্টিক ড্রাম ও পাত্র এবং ফুলের টবে লার্ভা বেশি ছিল।
অনুষ্ঠানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, এডিস মশার নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা জটিল। বহুতল ভবনে সিটি করপোরেশনের একজন মশককর্মীর জন্য প্রবেশ করা কঠিন। নগরবাসীকে সম্পৃক্ত না করতে পারলে এবার ডেঙ্গু পরিস্থিতি সামাল দেওয়া মুশকিল। ডেঙ্গুর হটস্পটগুলোকে (বেশি সংক্রমণ এমন এলাকা) আলাদা গুরুত্ব দিয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষ করে হটস্পটগুলোতে উড়ন্ত মশা মারতে ব্যবস্থা নিতে হবে।
জরিপ প্রকাশ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক রাশেদা সুলতানা, রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীনসহ ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালের পরিচালকেরা।
মশকনিধন কার্যক্রম নিয়ে অসন্তোষ
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কয়েক মাস আগে এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে সতর্ক করলেও ঢাকার দুই সিটি যথাযথ উদ্যোগ নেয়নি বলে নগরবাসীর অভিযোগ তুলে ধরেন সাংবাদিকেরা।
ঢাকা উত্তরের উপপ্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম মোস্তফা সারওয়ার বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের মশকনিধনে আমার কাজে আমি সন্তুষ্ট না। সিটি করপোরেশন জনসচেতনতা বাড়াতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। ৮ থেকে ১৩ জুলাই বিশেষ অভিযান চালাবে সিটি করপোরেশন।’ অন্য দিকে ঢাকা দক্ষিণের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ফজলে শামসুল কবির বলেন, তাঁরা মশকনিধন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
তবে অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক আহমেদুল কবির বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম আরও চার-পাঁচ গুণ বাড়াতে হবে।
পরিস্থিতি আরও খারাপের শঙ্কা
ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে দেরিতে ভর্তির কারণে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ৫০ জনের তথ্য পর্যালোচনা করে বলেছে, এ বছর ডেঙ্গুতে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের ৮০ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে ভর্তির এক থেকে তিন দিনের মধ্যে।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এবার বছরের প্রথম ছয় মাসেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। দেশে সাধারণত জুনের পর থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে। তাই আগামী দিনগুলোতে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেড়ে যেতে পারে। আর আক্রান্ত বেশি হলে মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে।