পেটে গুলি, বুকে গুলি, পায়ে গুলি, কাতরাচ্ছেন তাঁরা
‘আমি তো পঙ্গু হয়ে গেলাম! পরিবারের বোঝা হয়ে গেলাম’ বলছিলেন গুলি লাগার পর পা কেটে ফেলা এক ব্যক্তি।
কারও পেটে গুলি, কারও পিঠে গুলি, কারও পায়ে গুলি—শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৪২০ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি ২০ জনের মতো আহতের প্রায় সবাই গুলিবিদ্ধ। কারও লেগেছে একটি গুলি, কারও লেগেছে দুটি গুলি। অনেকগুলো ছররা গুলির ক্ষত নিয়েও ভর্তি কেউ কেউ।
হাসপাতালটিতে গত মঙ্গলবার গিয়ে আহতদের মধ্যে দেখা গেল একটি কিশোরকে। তার দুই পায়ে দুটি গুলি লেগেছে। পা দুটো ব্যান্ডেজ করা। পাশে বসা তার মামা। গিয়ে কথা বলতে চাইলে মামা সবকিছুই বললেন। তবে অনুরোধ জানালেন, তাঁদের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় যেন প্রকাশ করা না হয়।
আহত ব্যক্তির মামার দাবি, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজধানীর মিরপুরে সংঘর্ষের সময় বাসায় ফিরতে গিয়ে ১৯ জুলাই (শুক্রবার) গুলিবিদ্ধ হয় তাঁর ভাগনে। ঘটনাস্থল মিরপুর-১০ নম্বর সেকশন। আহত কিশোরটি স্থানীয় একটি স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
শরীরের ব্যথা তো কিছু না ভাই। আমি তো পঙ্গু হয়ে গেলাম! পরিবারের বোঝা হয়ে গেলাম।জাকির শিকদার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মী
আহতের মামা আরও বলেন, তাঁর ভাগনের দুই পায়ে যে দুটি গুলি লেগেছে, তা রাবার বুলেট বা ছররা গুলি নয়।
চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীটির ততটা ঝুঁকি নেই। তবে কারও কারও পঙ্গু হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। তাঁদের একজন জাকির শিকদার। তিনি জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) ক্যাজুয়ালটি-২ বিভাগে ভর্তি। বয়স ২৭ বছর। সংঘর্ষের মধ্যে ১৮ জুলাই (বৃহস্পতিবার) ঢাকার মধ্যবাড্ডা এলাকায় তাঁর বাঁ পায়ে গুলি লাগে। পা–টি ইতিমধ্যে অস্ত্রোপচার করে কেটে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন চিকিৎসকেরা।
জাকির নিজেকে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মী বলে উল্লেখ করেন। গত মঙ্গলবার তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘শরীরের ব্যথা তো কিছু না ভাই। আমি তো পঙ্গু হয়ে গেলাম! পরিবারের বোঝা হয়ে গেলাম।’ তিনি দাবি করেন, কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে তাঁর পায়ে গুলি লাগে।
সরেজমিনে গত মঙ্গলবার পঙ্গু হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি-২ বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে গুলিবিদ্ধ ৩৫ জন ভর্তি। এর মধ্যে সাতজনের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়। তাঁদের সবার শরীরে লেগেছিল একটি করে গুলি।
জাকিরের বাড়ি মাদারীপুর সদরে। তাঁর বাবা শাহজাহান শিকদার ২০০৭ সালে মারা যান। চার ভাই, এক বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। ছোট ভাই ও মাকে নিয়ে তিনি মধ্যবাড্ডায় ভাড়া থাকেন। পঙ্গু হাসপাতালে যখন তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখন তাঁর মা হনুফা বেগম পাশে বসে চোখ মুছছিলেন। তিনি শুধু বলছিলেন, ‘আমার ছেলে (জাকির) সবাইকে দেখে রেখেছিল, এখন আমার ছেলেকে কে দেখবে?’
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৫ জুলাই থেকে সংঘর্ষ শুরু হয়। পরে সংঘাত আরও বাড়ে। ১৬, ১৮, ১৯, ২০ ও ২১ জুলাই সংঘাতে এবং পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অন্তত ২০১ মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। এর মধ্যে শিশু-কিশোর, শিক্ষার্থী, তরুণ ও প্রবীণ নাগরিক এবং তিনজন পুলিশ সদস্য ও একজন আনসার সদস্য রয়েছেন। আহত বহু মানুষ। তাঁদের মধ্যে অনেকেই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
সরেজমিনে গত মঙ্গলবার পঙ্গু হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি-২ বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে গুলিবিদ্ধ ৩৫ জন ভর্তি। এর মধ্যে সাতজনের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়। তাঁদের সবার শরীরে লেগেছিল একটি করে গুলি। আহতদের মধ্যে ছিলেন ৯ জন শিক্ষার্থী। ৩৫ জনের মধ্যে ছিল ৫টি শিশু ও কিশোর। ১৯ জুলাই বাড্ডা থেকে আসা মুহিব্বুল্লাহ (৩৮) নামের একজনের ছিল বুকের এক পাশে গুলির আঘাত। তিনি গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক বনানী শাখায় নামাজ পড়ান।
নীরবের ভাষ্য, ঘটনার দিন তিনি রিকশা চালাচ্ছিলেন। হঠাৎ করেই বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া শুরু হয়। তিনি রিকশা নিয়ে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে যান। তখন পুলিশের ছোড়া গুলি তাঁর শরীরের বিভিন্ন অংশে লাগে।
আহতদের একজন মো. সিফাত (১৪)। সে মিরপুরের পল্লবী মাজেদুল ইসলাম মডেল হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। সে জানায়, ১৮ জুলাই (বৃহস্পতিবার) রাত ৯টার দিকে মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায় তার ডান পায়ে গুলি লাগে।
সিফাতের বাবা মো. সিরাজ একটি বেসরকারি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের কর্মী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে তিনি পল্লবীতে থাকেন। ঘটনার দিন তাঁর ছেলে সিফাত এক বন্ধুর সঙ্গে মিরপুর-১০ নম্বরে গিয়েছিল। বাসায় ফেরার পথে রাস্তা পারাপারের সময় তার পায়ে গুলি লাগে।
পঙ্গু হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি-২ বিভাগের চিকিৎসকেরা জানান, সেখানে ভর্তি রোগীরা সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাঁদের আনা হয়েছে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, উত্তরা, বাড্ডা, নারায়ণগঞ্জ প্রভৃতি এলাকা থেকে। আহতদের মধ্যে শিক্ষার্থী ছাড়াও রিকশাচালক, দিনমজুর, চাকরিজীবী, গাড়িচালকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ রয়েছেন। একজন শিক্ষকও রয়েছেন।
পঙ্গু হাসপাতালে গত মঙ্গলবার ও গতকাল বুধবার খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৭ থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত পাঁচ দিনে হাসপাতালটিতে সংঘর্ষকালে আহত ১ হাজার ২৬৯ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ২৩১ জন গুলিবিদ্ধ। আর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র বলছে, ১৯ ও ২০ জুলাই ৪৭২ জন গুলিবিদ্ধ রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। তবে গত বৃহস্পতিবার ও রোববার কতজন গুলিবিদ্ধ রোগী এসেছেন, সেই তথ্য নেই।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে মোট ১০ জন গুলিবিদ্ধ ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের ৫ জন একক গুলিতে আহত। ৫ জন ছররা গুলিতে আহত। হাসপাতালটিতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মো. হাসান (১৭) নামের এক কিশোরকে পাওয়া যায়। ১৮ জুলাই (বৃহস্পতিবার) রাত সাড়ে ৯টার দিকে মোহাম্মদপুরের কাটাসুর এলাকায় সে গুলিবিদ্ধ হয়। গুলিটি তার ডান হাতের ওপরের অংশে লাগে। হাসানের ভাষ্য, সে একটি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মী।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক শফিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গুলিবিদ্ধ রোগীদের পাশাপাশি ১২ জন ব্যক্তিকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালটিতে আনা হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, কয়েক দিন পরিস্থিতি খুব খারাপ ছিল। রোগী সামলাতে হিমশিম খেতে হয়েছে।
শ্রমজীবী মানুষ গুলিবিদ্ধ
মো. নীরবের (৩৫) বাড়ি ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায়। ঢাকায় রিকশা চালিয়ে সংসার চালান তিনি। ১৯ জুলাই (বৃহস্পতিবার) তিনি মোহাম্মদপুর চাঁদ উদ্যান এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। এখন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁর শরীরে অনেকগুলো ছররা গুলির আঘাত।
নীরবের ভাষ্য, ঘটনার দিন তিনি রিকশা চালাচ্ছিলেন। হঠাৎ করেই বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া শুরু হয়। তিনি রিকশা নিয়ে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে যান। তখন পুলিশের ছোড়া গুলি তাঁর শরীরের বিভিন্ন অংশে লাগে।
১৯ জুলাই (শুক্রবার) বিকেলে অসুস্থ স্ত্রীকে রূপনগর এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করে বাসায় ফিরছিলেন। রাস্তায় তাঁর পেটের এক অংশ দিয়ে গুলি ঢুকে অপর পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়।
১৯ জুলাই মোহাম্মদপুরের চান মিয়া হাউজিং এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন মো. হাবিব (৩০)। তিনি দিনমজুর। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হাবিবের ভাষ্য, তিনি থাকেন মোহাম্মদপুর এলাকায়। ঘটনার দিনমজুরি নিতে চান মিয়া হাউজিং এলাকায় গিয়েছিলেন। পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষের মধ্যে তাঁর পেটে ও পিঠে ২১২টি ছররা গুলি লাগে।
একই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রফিকুল ইসলাম (২৩) মিরপুরের একটি প্রিন্টিং কারখানার শ্রমিক। তাঁর ভাষ্য, স্ত্রী আমেনা বেগমকে নিয়ে তিনি থাকেন মিরপুর-১২ নম্বর এলাকায়। তাঁর স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। ১৯ জুলাই (শুক্রবার) বিকেলে অসুস্থ স্ত্রীকে রূপনগর এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করে বাসায় ফিরছিলেন। রাস্তায় তাঁর পেটের এক অংশ দিয়ে গুলি ঢুকে অপর পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়।
গুলিবিদ্ধ হয়ে দুই হাসপাতালে ভর্তি অনেকেই আহত হওয়া নিয়ে কথা বলতে রাজি নন। তাঁরা বলেছেন, পরিচয় জানিয়ে কোনো ঝামেলায় তাঁরা পড়তে চান না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মিরপুরের কাজীপাড়ার একজন দোকানদার বলছিলেন, ১৯ জুলাই (শুক্রবার) রাতে বাসার সামনে বের হতেই তাঁর পায়ে গুলি লাগে। সংঘর্ষ হচ্ছিল তাঁর বাসা থেকে অনেক দূরে। তিনি বলেন, তাঁর ধারণা, গুলিটি অনেক দূর থেকে এসে তাঁর পায়ে লেগেছে।