কেমন চলছে রাজধানী ও বিভাগীয় শহরের আবাসন খাত
নাগরিকের মৌলিক চাহিদার মধ্যে বাসস্থান বা আবাসন অন্যতম। বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী গ্রামে বসবাস করে। বাকিদের অবস্থান ছোট-বড় শহরে। যার মধ্যে রয়েছে ঢাকার মতো মেগাসিটিও। তাই ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে রাজধানীতে প্রতিবছর তৈরি হচ্ছে হাজার হাজার নতুন অ্যাপার্টমেন্ট।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) সূত্রে জানা যায়, ২০১০-১২ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ১৫ হাজারের কাছাকাছি ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি হয়েছে। সূত্রমতে, ২০১৩-১৬ সালে ১২ হাজার, ২০১৭-২০ সাল পর্যন্ত ১৪ হাজার, ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ১৫ হাজারের কাছাকাছি ফ্ল্যাট বিক্রি হয়েছে। এরপর রাজউক কর্তৃক ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) বাস্তবায়ন এবং নির্মাণ উপকরণের মূল্যবৃদ্ধিতে বিক্রি কমে আসে ফ্ল্যাটের। তাই ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিক্রি হয় ১০ হাজারের কাছাকাছি, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আরও কমে সেটি ১০ হাজারের নিচে অবস্থান করছে। এদিকে বিক্রি কমলেও দাম কমেনি ফ্ল্যাটের।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক জিডিপি উপাত্তে দেশে ফ্ল্যাটের ক্রমবর্ধমান চাহিদার দিকটি উঠে এসেছে। আবাসন খাত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হয়েছে সেখানে। এ বৃদ্ধি গত চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত দেশে ২৪ হাজার কোটি টাকার ফ্ল্যাট বিক্রি হয়েছে, যা আগের তিন বছরের ২১ হাজার কোটি টাকা, ১৭ হাজার কোটি টাকা এবং ১১ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়েছে। দ্রুত নগরায়ণের কারণে আবাসন মার্কেটের আকারও বাড়ছে। এ ছাড়া দেশে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় আসে, তার একটি বড় অংশই বিনিয়োগ করা হয় এ খাতে।
আন্তর্জাতিক বাজার গবেষক সংস্থা স্ট্যাটিস্টা মার্কেট ইনসাইটসের তথ্যমতে, ২০২০ সালে রিয়েল এস্টেট বাজারের আকার ছিল ২ দশমিক ১৬ ট্রিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে ২ দশমিক ২৮ ট্রিলিয়ন ডলার, ২০২২ সালে ২ দশমিক ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলার এবং ২০২৩ সালে ২ দশমিক ৪৮ ট্রিলিয়ন ডলার হয় এটি। ২০২৪ সাল শেষে বাংলাদেশের আবাসনের বাজার ২ দশমিক ৬৮ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা ২০২৪ থেকে ২০২৮ সাল নাগাদ এ বাজার বার্ষিক ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ হারে বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। ফলে ২০২৮ সালের মধ্যে দেশের আবাসন খাতের বাজার দাঁড়াবে ৩ দশমিক ৫৩ ট্রিলিয়ন ডলারে। আবাসিক রিয়েল এস্টেট এ বাজারে আধিপত্য বিস্তার করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে কথা হয় রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দেশের আবাসন খাতে জমির চেয়ে বেশির ভাগ বিনিয়োগ ফ্ল্যাটে হচ্ছে। পাশাপাশি নির্দিষ্টসংখ্যক আবাসন প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক স্থানে বিনিয়োগ করে থাকে। অন্যদিকে ক্রেতাদের অনেকে সঞ্চয়ের অন্যতম উপায় হিসেবে বা ভবিষ্যতে নিজের বাড়ি নির্মাণের জন্য জমি ক্রয় করে থাকেন। তবে গ্রাহকেরা প্লট বা ফ্ল্যাট কেনার আগে প্রথমে সামর্থ্যের কথা ভাবেন। তারপর ভাবেন আস্থাভাজন বা স্বনামধন্য আবাসন প্রতিষ্ঠানের কথা, যেখান থেকে ক্রয় করবেন।’
লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেন, ‘গ্রাহকেরা ক্রমে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা এবং স্কুল, হাসপাতাল ও শপিং সেন্টারের মতো প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলোতে সহজে আসা-যাওয়া করা যায়, এমন সুবিধাসহ সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন খুঁজছেন। পাশাপাশি গেটেড কমিউনিটি এবং হাই-রাইজ অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের প্রতিও মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। এসব আবাসন কমপ্লেক্স ব্যক্তিকে নিরাপত্তা এবং গোষ্ঠীগত জীবনযাপনের অনুভূতি দেয়।’
সম্প্রতি ঢাকায় বেশি উচ্চতার ভবন নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। জমির দাম নাগালের বাইরে চলে গেছে। নির্মাণসামগ্রীর দামও ঊর্ধ্বমুখী। ফলে সস্তায় ফ্ল্যাট করার সুযোগ একেবারেই কম। এ কারণে ঢাকার অ্যাপার্টমেন্ট কেনা সাধারণ আয়ের মানুষের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ছে। তাই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, মানুষের ঢাকামুখী কমাতে হবে। কারণ, পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, আগামী দিনে ঢাকায় নিম্নমধ্যবিত্তদের থাকার কোনো জায়গা থাকবে না। লন্ডন ও কলকাতার মতো প্রতিদিন সকালে ট্রেনে করে কর্মস্থলে এসে আবার বিকেলে ট্রেনে করে ফিরে যেতে হবে নিজ এলাকায়। এ জন্য উন্নত করতে হবে যোগাযোগব্যবস্থা। যাতে গাজীপুর, টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জ বা নরসিংদী এলাকার মানুষ সকালে ঢাকায় এসে কাজ করে আবার সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে যেতে পারেন।
তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, নাগরিক সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে জেলা শহরেও মানুষ অ্যাপার্টমেন্ট কিনবেন। এতে মানুষকে তাঁর শিকড়ে ফেরানো যাবে। ফলে ঢাকার বাইরের আবাসনেই ভবিষ্যতে বড় সম্ভাবনা দেখা দেবে, যা ইতিমধ্যে দেশের শীর্ষস্থানীয় আবাসন প্রতিষ্ঠানের ঢাকার বাইরে নেওয়া প্রকল্পগুলো দেখে সহজেই অনুমান করা যায়।