কারাগারগুলো সংস্কার অপরিহার্য হয়ে পড়েছে

কারা অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক বলেছেন, কারাগারের সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি আছে। ভালো করার চেষ্টা চলছে।

‘কারাগার সংস্কার: বাস্তবতা ও করণীয়’ শীর্ষক কর্মশালায় আলোচকেরাছবি: প্রথম আলো

দেশে বিদ্যমান কারাবিধি, দণ্ডবিধি যুগোপযোগী করা এবং কারাগারগুলো সংস্কার অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। আজ শনিবার পুরান ঢাকার কারা কনভেনশন হলে ‘কারাগার সংস্কার: বাস্তবতা ও করণীয়’ শীর্ষক কর্মশালায় আলোচকেরা এ কথা বলেন।

কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে অন্তর্বর্তী সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয় এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, কারাগার, আদালত সর্বোপরি সমাজব্যবস্থা পরিবর্তন করতে একসঙ্গে উদ্যোগ নিতে হবে। আলাদাভাবে সম্ভব নয়। কারাগারের সংস্কারের জন্য একসঙ্গে চেষ্টা করতে হবে। আদালতগুলোতে যেন নির্যাতিত মানুষের সংখ্যা কমে আসে। বিচারগুলো যেন হয়।

দুবার কারাগারে গিয়েছিলেন উল্লেখ করে আদিলুর রহমান খান বলেন, বিগত ১৫ বছর মানুষ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারেনি। ভয়ের সংস্কৃতি, ভয়ের শাসন ও ফ্যাসিবাদের কারণে স্বাধীনভাবে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

কর্মশালায় কারা অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন বলেন, ‘কারাগারের সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি আছে। আমরা ভালো করার চেষ্টা করছি। কারাগারকে মন্ত্রণালয় ও রাজনীতিকেরা প্রভাবিত করেন। যে কারণে কারাগারকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে চালানো যায়নি।’ তিনি বলেন, কারাগারে এখন ৪২ হাজার কয়েদির ধারণক্ষমতা রয়েছে। সেখানে আছেন ৫২ হাজার। পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় বন্দীদের আলাদা ব্যারাকে রাখা যাচ্ছে না। ফলে চোর কারাগারে এসে ডাকাত হয়ে বের হচ্ছেন।

কারা অধিদপ্তরের এই মহাপরিদর্শক বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ১৭টি কারাগারে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। পরে সব কারাগারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হয়েছে। দেশের সব কারাগারে এখন নিরাপদ ও স্বাভাবিক পরিবেশ রয়েছে।

বন্দীদের ৮ ঘণ্টা সেলের বাইরে থাকার অনুমতি দেওয়া উচিত

ল রিপোর্টার্স ফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হাসান জাবেদের সভাপতিত্বে কর্মশালায় প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। তিনি বলেন, হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক চূড়ান্ত অনুমোদন না পাওয়া পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে কনডেমড সেলে রাখা যাবে না। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর প্রক্রিয়া অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি বিষয়, তাই এটি আইনের দ্বারা পরিচালিত হতে হবে এবং বন্দীর মানবাধিকারের প্রতি যথাযথ সম্মান রাখতে হবে।

শিশির মনির বলেন, কারাগারে থাকা বন্দীদের সঙ্গে আইনজীবীদের শারীরিকভাবে ও ভার্চ্যুয়ালি পরামর্শ করার সুযোগ দেওয়া ও ভার্চ্যুয়ালি শুনানিতে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া উচিত।

প্রবন্ধে বলা হয়, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধাগুলো মানবাধিকারের মানদণ্ড পূর্ণ করে না। তাঁদের অন্য বন্দীদের থেকে আলাদা রাখা উচিত। মৃত্যুদণ্ড-সংক্রান্ত ডেথ রেফারেন্স ও ফৌজদারি আপিলসমূহের দ্রুত ও কার্যকর শুনানির ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তাঁদের লাইব্রেরি পরিচালনা, ধর্মীয় কাজ, বাগান করা ইত্যাদি কাজে নিযুক্ত করা দরকার। তাঁদের প্রতিদিন অন্তত ৮ ঘণ্টা সেলের বাইরে খোলা জায়গায় থাকার অনুমতি দেওয়া উচিত। শারীরিক ব্যায়াম ও খেলাধুলার সুযোগ ও মানসম্পন্ন খাবার পরিবেশন করা দরকার।

প্রবন্ধে আরও বলা হয়, কয়েদিদের মাসে দুবার তাঁদের আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করা, স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাতেরও সুযোগ দেওয়া উচিত। স্যানিটারি সুবিধাগুলো কক্ষের বাইরে থাকা উচিত ও প্রতিটি বন্দীর জন্য আলাদা তালা ও চাবি থাকা দরকার। বন্দীদের জন্য স্বামী-স্ত্রীর সহবাস ও প্রজননের অধিকার একটি মানবিক প্রয়োজন। এই অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাঁদের ব্যক্তিগত জীবন ও মানবিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন সম্ভব।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ, কারা উপমহাপরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবির, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল, সাবেক কারা উপমহাপরিদর্শক মো. শামসুল হায়দার সিদ্দিকী, নিউ এজ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক শহীদুজ্জামান। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ল রিপোর্টার্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মিশন।

অনুষ্ঠানে আলোচকেরা রাজনৈতিক বিবেচনায় কারাগারে ডিভিশন পাওয়া ও কারাগারের ভেতরের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির সমালোচনা করেন এবং সংস্কারের দাবি তোলেন।