বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়: কাজ অর্ধেক, ব্যয় ৫৫ কোটি টাকা, এখন প্রকল্পই বাতিল
প্রকল্পের মাঝপথে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেন বিশ্ববিদ্যালয়টির তৎকালীন উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ। এরপর প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে নতুন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেন। পরিবর্তন করান ১০তলা দুটি ভবনের নকশা। আরও নানা অনিয়মের কারণে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও কাজ শেষ হয়নি।
এ পরিস্থিতিতে ওই প্রকল্প বাতিল করেছে পরিকল্পনা কমিশন। এরই মধ্যে এই প্রকল্পে দুটি ভবনের পাঁচতলা পর্যন্ত নির্মাণসহ সার্বিক ব্যয় হয়েছে ৫৫ কোটি টাকা।
রংপুরে অবস্থিত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে নেওয়া এই প্রকল্পে অনিয়মের জন্য তৎকালীন উপাচার্য (২০১৭-২১) নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে তাঁর বিরুদ্ধে অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে পরিকল্পনা কমিশন গত জুলাইয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে অসমাপ্ত অবস্থায় প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা করার কথা জানায়।
শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের বিচার করে প্রয়োজনে নতুন প্রকল্প নিয়ে কাজ শেষ করা উচিত। সেটি সম্ভব না হলে যতটুকু কাজ হয়েছে, তা ব্যবহার উপযোগী করার উদ্যোগ নিতে হবে।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১৫ সালে ৯৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে অনুমোদন দেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এই প্রকল্পের আওতায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে এক হাজার আসনের ১০তলা আবাসিক ছাত্রী হল ও তাঁর স্বামী পরমাণুবিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার নামে ১০তলা গবেষণা ইনস্টিটিউট ভবনের নির্মাণকাজ চলছিল। পাশাপাশি একটি স্বাধীনতা স্মারক নির্মাণ করার কথা ছিল। ২০১৮ সালের জুনে এ প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও তিন দফায় সময় বাড়িয়েও তা শেষ করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ২০২১ সালের জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। মেয়াদ শেষ হওয়ার ৮ মাস পর মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করা হয়।
পরিকল্পনা কমিশন গত ১৬ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে এই প্রকল্পে দরপত্র আহ্বানসহ বাস্তবায়ন পর্যায়ে নানা ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে বলে উল্লেখ করে। এ ছাড়া প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তা বৃদ্ধির সুযোগ নেই জানিয়ে কাজ অসমাপ্ত অবস্থায় প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা করার কথা জানায়। পাশাপাশি অসমাপ্ত কাজ সুষ্ঠুভাবে শেষ করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ চাইলে নতুন প্রকল্প নিতে পারে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। একই চিঠিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মাধ্যমে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। ইতিমধ্যে দুদক এই প্রকল্পের অনিয়ম খতিয়ে দেখার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
অনিয়মে জড়িত ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তবে এ প্রকল্পের আওতায় যতটুকু অবকাঠামো হয়ে গেছে, এখন উচিত হবে তা ব্যবহারযোগ্য করা।ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছি অল্প কিছুদিন আগে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
অনিয়মের চিত্র
ইউজিসি ও আইএমইডির সরেজমিনে প্রতিবেদন ও বিভিন্ন নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কলিম উল্লাহ উপাচার্য হয়ে ২০১৭ সালের জুনে ওই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেন।
নতুন পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে শেখ হাসিনা ছাত্রী হল ও ওয়াজেদ মিয়া গবেষণা ইনস্টিটিউটের আগের নকশা বদলে ফেলেন কলিম উল্লাহ। ছাত্রী হলের আগের ও পরের নকশার পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রথম নকশায় হলে এক হাজার ছাত্রীর জন্য ৩২৫টি শৌচাগারের (টয়লেট) পরিকল্পনা ছিল। দ্বিতীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নকশা পরিবর্তন করে সেখানে ৭২৫টি শৌচাগার করে। আর ওয়াজেদ মিয়া ইনস্টিটিউট ১০তলা ভিতের ওপর ১০তলাবিশিষ্ট ভবনের কথা বলা হলেও একটির পরিবর্তে তিনটি ভবন নির্মাণ করা হচ্ছিল।
পরিকল্পনা কমিশন বলছে, প্রথম নকশা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদিত হয়। এসব নকশা পরিবর্তন সরকারের আর্থিক শৃঙ্খলার পরিপন্থী। ইউজিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী প্রধান এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে থাকার কারণে নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ এ দায়দায়িত্ব বহন করা উচিত।
নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির কোনো তদবির না শোনায় তিনি (দীপু মনি) ইউজিসিসহ সরকারের সব শক্তি আমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছেন।’
এ প্রকল্পে যাঁরা অনিয়ম করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভবন দুটির যতটুকু কাজ হয়েছে, সেটি ব্যবহারের উপযোগী করতে হবে।
ব্যয় হয়ে গেছে ৫৫ কোটি টাকা
প্রকল্পের নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শেখ হাসিনা ছাত্রী হল নির্মাণে এ পর্যন্ত ৩৫ কোটি ও ড. ওয়াজেদ মিয়া ইনস্টিটিউটে ১৩ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য গবেষণা সরঞ্জাম কিনতে ব্যয় হয়েছে তিন কোটি টাকার বেশি। পাশাপাশি পরামর্শক, আসবাব কেনাকাটায়সহ আরও কিছু খাত মিলে খরচ হয়েছে চার কোটি টাকা। আর প্রকল্পের কাজ হয়েছে প্রায় ৫৭ শতাংশ।
৯ অক্টোবর সরেজমিনে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নির্মাণাধীন ভবন দুটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। শেখ হাসিনা হলের পাঁচতলা পর্যন্ত ছাদ নির্মাণ হয়েছে। দেয়াল হয়নি। চারদিকে ঝোপজঙ্গলে ভরে গেছে। যদিও টিন দিয়ে ঘেরা রয়েছে। ওয়াজেদ মিয়া গবেষণা ইনস্টিটিউট ভবনটিরও পাঁচতলা পর্যন্ত ছাদ নির্মাণ হয়েছে। এটিরও দেয়াল নির্মাণ হয়নি। ভবনটি ঝোপজঙ্গলে ভরে গেছে।
হল যতটুকু হয়েছে, ততটুকু দ্রুত বাস উপযোগী করার দাবি জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী সাদিয়া ইয়াসমিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক দিন ধরে দেখছি, হলের কাজ হচ্ছে; কিন্তু শেষ হচ্ছে না।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এ প্রকল্পে তৎকালীন ভিসি (কলিম উল্লাহ) ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। এতে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় হয়েছে। অনিয়মে জড়িত ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তবে এ প্রকল্পের আওতায় যতটুকু অবকাঠামো হয়ে গেছে, এখন উচিত হবে তা ব্যবহারযোগ্য করা।
[তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আরিফুল হক, নিজস্ব প্রতিবেদক, রংপুর]