দিন কাটছে না সমর বিজয় চাকমাদের

কাপ্তাই হ্রদে মাছ ধরা বন্ধ থাকায় নৌকার রশি ও জাল মেরামত করছেন জেলেরা। আজ সকালে রাঙামাটি সদরের বিলাইছড়ি পাড়ায়সুপ্রিয় চাকমা।

রাঙামাটি সদর থেকে আট কিলোমিটার দূরে বিলাইছড়িপাড়ার অবস্থান। পাড়ার তিন দিকেই কাপ্তাই হ্রদ। এক দিকে সরু একটি রাস্তা যুক্ত আছে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে। তবে বর্ষায় হ্রদের পানি বাড়লে সেই রাস্তাও ডুবে যায়। বিলাইছড়িপাড়ায় ১২০ পরিবারের বসবাস। সবাই পেশায় মৎস্যজীবী। হ্রদে মাছ ধরা বন্ধ থাকায় পাড়াটি এখন একরকম কর্মব্যস্তহীন। জাল মেরামত আর নৌকা সারানো বাদ দিলে এখানকার জেলেদের হাতে এখন তেমন কোনো কাজ নেই। মাছ ধরা বন্ধের সময় সরকারি সহায়তা হিসেবে কাপ্তাই হ্রদের প্রতিটি জেলে পরিবার মাসে ২০ কেজি করে চাল পাচ্ছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় এই সহায়তাকে নগণ্য বলছেন জেলেরা।

বিলাইছড়িপাড়ার ভেতরে ছোট তিন থেকে চারটি দ্বীপ রয়েছে। পাড়া থেকে নৌকায় যেতে হয় দ্বীপগুলোয়। আজ রোববার সকালে তেমনই একটি দ্বীপে গিয়ে দেখা গেল, হ্রদের তীরে অলস সময় কাটাচ্ছেন জেলেরা। কথা বলতে চাইলে তাঁদের একজন সমর বিজয় চাকমা (৫২) উঠে আসেন। মাছ ধরা বন্ধের সময় কেমন কাটছে, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, পরিবারে ছয় সদস্য নিয়ে ভীষণ কষ্টে আছেন। অন্য কোনো আয়ের উৎস থাকায় ঋণ নিয়ে দৈনন্দিন খরচ মেটাচ্ছেন। প্রতি মাসে তাঁর পরিবারের খোরাকি লাগে অন্তত ১০০ কেজি চাল। কিন্তু বরাদ্দ আছে মাত্র ২০ কেজি। এই চাল পেলেও তাই ঋণ করতে হবে তাঁদের।

কাপ্তাই হ্রদে মাছ ধরা বন্ধ। অলস সময় পার করছেন মৎস্যজীবী বাবু রাম চাকমা, স্নেহ লাল চাকমা ও সমর বিজয় চাকমা। আজ সকালে রাঙামাটি সদরের বিলাইছড়ি পাড়ায়
সুপ্রিয় চাকমা।

মৎস্যজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ২৫ এপ্রিল থেকে রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদে মাছ শিকার বন্ধ হয়ে যায়। এর পর থেকে সমর বিজয়ের মতো কাপ্তাই হ্রদের ২৬ হাজার ৮৬৬ জেলে মৎস্যজীবীর উপার্জনের পথও বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যেই সমরের জমানো টাকা শেষ। মহাজনের কাছ থেকে ঋণ করেই এখন সংসার চালাচ্ছেন। মৎস্যজীবীদের পাশাপাশি এই পেশায় নিয়োজিত আরও হাজারখানেক শ্রমিক এখন বেকার সময় কাটাচ্ছেন।

জেলেরা অভিযোগ করেন, কাপ্তাই হ্রদের জেলেদের জন্য প্রতি মাত্র মাসে ২০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়। তা প্রয়োজনের তুলায় অত্যন্ত নগণ্য। অনেক সময় মাত্র দুই বা এক মাসের চাল দেওয়া হয়। অথচ ৪ থেকে ৬ সদস্যের পরিবারের জন্য অন্তত ১০০ কেজি চাল প্রয়োজন। অন্য কোনো উপায় না থাকায় অধিকাংশ জেলে পরিবার ঋণ নিয়ে দিন পার করছে। অনেকে খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন।

জেলা মৎস্য কার্যালয় ও রাঙামাটির মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, কাপ্তাই হ্রদে মাছের নিরাপদ প্রাকৃতিক প্রজনন নিশ্চিত করতে প্রতিবছরই মাছ শিকারে তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে মাছ বাজারজাতকরণ, সংরক্ষণ ও পরিবহন নিষিদ্ধ করা হয়। বৃষ্টি হলে ও কাপ্তাই হ্রদে পানি বাড়লে তিন মাসের মধ্যে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। নয়তো নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়ে।

বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) সূত্রে জানা গেছে, নিষেধাজ্ঞা জারির ফলে কাপ্তাই হ্রদে রাজস্ব আয় বেড়েছে। গত ২৫ এপ্রিল মধ্যরাত পর্যন্ত মোট ১৫ কোটি ৫৬ লাখ ৫৬ হাজার ৯১৭ টাকা রাজস্ব আদায় করতে সক্ষম হয়েছে বিএফডিসি। গত মৌসুমের তুলনায় ৪৫ দিন সময় কম পেলেও এই রাজস্ব আদায়কে অনন্য বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তবে বিপুল রাজস্ব আয় হলেও জেলেদের ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি সেই অর্থে।

কাপ্তাই হ্রদের মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি উনয়ন বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাছ শিকার ও আহরণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বহু মানুষ মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। জেলেদের পাশাপাশি আমাদের ব্যবসায়ী ও শ্রমিকেরা চরম কষ্টে রয়েছেন। জেলেরা যে প্রণোদনা পান, তা যথেষ্ট নয়। মাত্র ২০ কেজি করে দেওয়া হয়, আমরা ৩০ কেজি করে দেওয়ার আবেদন করেছি। পাশাপাশি শ্রমিকদেরও প্রণোদনার আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন।’