পাহাড়চূড়ায় ৩৫৬ বছরের মসজিদ
চট্টগ্রাম শহরে মোগল স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত আন্দরকিল্লা জামে মসজিদটি সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৩০ ফুট ওপরে পাহাড়চূড়ায় । ১৬৬৬ সালের ২৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মোগলদের অধিকারে আসে। এর এক বছর পর মসজিদটি নির্মিত হয়
মসজিদের মূল ফটকের পর সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠলে চোখে পড়বে অনিন্দ্যসুন্দর স্থাপত্যে গড়া মসজিদের মূল ভবন, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভারতবর্ষের মোগল শাসকদের অন্যতম গর্বের ইতিহাস—চট্টগ্রাম বিজয়ের ঘটনা। এটি সাড়ে তিন শতাব্দীর পুরোনো আন্দরকিল্লা জামে মসজিদ।
দিল্লির শাহি জামে মসজিদের অনুকরণে তৈরি চট্টগ্রাম শহরের এই মসজিদে মূল ইমারতের প্রবেশপথে কালো পাথরের গায়ে খোদাই করে সাদা অক্ষরে ফারসি ভাষায় শিলালিপি রয়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়া থেকে জানা যায়, শিলালিপিতে বাংলার সুবাদার শায়েস্তা খান এটি ১৬৬৭ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণ করেন বলে উল্লেখ আছে। যদিও ধারণা করা হয়, এ মসজিদের প্রকৃত নির্মাতা শায়েস্তা খানের বড় ছেলে ও চট্টগ্রাম বিজেতা উমেদ খান। তবে তাঁর নাম ওই শিলালিপিতে উল্লেখ নেই।
সরেজমিনে দেখা যায়, সারি সারি বইয়ের দোকান আর নানা পণ্যের পসরা নিয়ে গড়ে ওঠা বিপণিকেন্দ্র চমৎকার স্থাপত্যের এই মসজিদকে অনেকটাই ঢেকে রেখেছে। গত বুধবার আসরের নামাজের জামাতের পর বৃষ্টিস্নাত বিকেলে শেষ বিকেলের রোদ এসে পড়ছিল মসজিদের মিনারে। মসজিদের খোলা চত্বরের এক পাশে বসে কথা হয় মুসল্লি মো. আবু বক্কর সিদ্দিকীর সঙ্গে। তিনি থাকেন পাশের চেয়ারম্যান রোডে। ৩০ বছর ধরে এই মসজিদের নিয়মিত মুসল্লি তিনি। তিনি বলেন, ‘এটা ঐতিহাসিক এক মসজিদ। এখানকার মূল মসজিদ কক্ষটি সাড়ে তিন শ বছরের পুরোনো। এখানে বসলেই মনে শান্তি আসে।’
১৭৬১ সালে নবাব মীর কাসিম পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান মেদিনীপুর জেলাসহ বর্তমান চট্টগ্রামের কর্তৃত্ব ইংরেজদের হাতে ছেড়ে দেন। ইংরেজরা চট্টগ্রামের কর্তৃত্ব গ্রহণ করার পর আন্দরকিল্লা মসজিদকে অস্ত্রাগার ও আস্তাবলে পরিণত করে
ড. সেলিম জাহাঙ্গীরের লেখা ‘আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদ’, আবদুল হক চৌধুরীর ‘বন্দর শহর চট্টগ্রাম’ বইতে মোগল আমলের চট্টগ্রাম ও আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদ সম্পর্কে নানা তথ্য মেলে। ঐতিহাসিকদের মতে, চট্টগ্রাম বিজয়ের স্মৃতি ধরে রাখতে সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে শায়েস্তা খান ১৬৬৭ খ্রিষ্টাব্দে আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদ নির্মাণ করেন। তবে চট্টগ্রাম বিজয় ও মসজিদ নির্মাণের পুরো বিষয়টিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁর ছেলে উমেদ খান।
মোগল স্থাপত্যরীতিতে এই মসজিদ সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৩০ ফুট ওপরে পাহাড়চূড়ায় নির্মিত হয়েছে। মূল মসজিদের নকশা অনুযায়ী এটি ১৮ গজ দীর্ঘ, সাড়ে ৭ গজ প্রশস্ত। মসজিদের পশ্চিমের দেয়াল পোড়ামাটির ইটে তৈরি, বাকি তিনটি দেয়াল পাথরের। ছাদের মধ্যে একটি বড় গম্বুজ ও দুটি ছোট গম্বুজ। চারটি অষ্টভুজাকৃতি বুরুজের মধ্যে পেছন দিকের দুটি এখনো টিকে আছে।
কেমন ছিল তখনকার চট্টগ্রাম? উল্লিখিত ‘বন্দর শহর চট্টগ্রাম’ বই থেকে জানা যায়, মধ্যযুগ থেকেই সমুদ্রবন্দর হিসেবে চট্টগ্রামের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে মোগলদের বাংলা বিজয়ের আগে চট্টগ্রাম পুরোপুরি আরাকানিদের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল। সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে সুবাদার ইসলাম খান চিশতি আরাকানিদের হাত থেকে ফেনী নদী পর্যন্ত অঞ্চল পুনরুদ্ধার করেছিলেন। পরে সম্রাট জাহাঙ্গীরের আরও কয়েকজন সুবাদার চট্টগ্রাম দখল করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।
এটা ঐতিহাসিক একটি মসজিদ। মূল মসজিদকক্ষটি সাড়ে তিন শ বছরের পুরোনো। এখানে বসলেই মনে শান্তি আসেআবু বক্কর সিদ্দিকী, মুসল্লি, আন্দরকিল্লা মসজিদ
আরাকানি মগ ও তাদের সঙ্গে মিলে পর্তুগিজ জলদস্যুরা তখন বাংলায় লুটতরাজ চালাত। কখনো কখনো তারা ঢাকাও আক্রমণ করত। জলদস্যুদের কারণে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত বিভিন্ন নদীর দুই তীর অর্থাৎ উপকূলীয় জেলাগুলো তখন প্রায় জনমানবশূন্য হয়ে পড়েছিল। তারা স্থানীয় লোকজনকে ধরে নিয়ে দাস হিসেবেও বিক্রি করত।
বাংলার দায়িত্ব নিয়ে শায়েস্তা খান জলদস্যুকবলিত চট্টগ্রামে অভিযান চালাতে চাইলেন। ১৬৬৫ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ছেলে উমেদ খানকে সেনাপতি করে চট্টগ্রাম বিজয় অভিযানে পাঠান তিনি। তখন নৌ-সেনাপতি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ইবনে হোসেনকে। ১৬৬৬ সালের ২৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মোগল অধিকারে আসে। এর এক বছর পরেই নির্মিত হয় এই মসজিদ।
নির্মাণের পর থেকেই চট্টগ্রামের ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের পীঠস্থান হয়ে ওঠে আন্দরকিল্লার এই মসজিদ। কিন্তু ১৭৬১ সালে নবাব মীর কাসিম পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান মেদিনীপুর জেলাসহ বর্তমান চট্টগ্রামের কর্তৃত্ব ইংরেজদের হাতে ছেড়ে দেন।
মসজিদের বিশাল আঙিনা, কারুকার্যখচিত খিলান আর গম্বুজ দেখলে পারস্যরীতির স্থাপত্যশৈলীর কথা মনে পড়বে। দিল্লি জামে মসজিদের আদলে বড় বড় পাথর ব্যবহার করে নির্মিত বলে এই মসজিদকে ‘পাথরের মসজিদ’ও বলা হয়
ইংরেজরা চট্টগ্রামের কর্তৃত্ব গ্রহণ করার পর আন্দরকিল্লা মসজিদকে অস্ত্রাগার ও আস্তাবলে পরিণত করে। এরপর প্রায় এক শ বছর ইংরেজদের অধীনে থেকে যায় মসজিদটি। ১৮৫৩-৫৪ সালে ইংরেজ সরকারের কাছে মসজিদটি মুসলমানদের নামাজের জন্য ফেরত দিতে আবেদন জানান স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা। ১৮৮৫ সালের ১৯ নভেম্বর ইংরেজ সরকার এই মসজিদ আবারও ব্যবহারের অনুমতি দেয়। কয়েকবার সংস্কারের পর মসজিদটি এখন নবরূপ পেয়েছে।
মসজিদের বিশাল আঙিনা, কারুকার্যখচিত খিলান আর গম্বুজ দেখলে পারস্যরীতির স্থাপত্যশৈলীর কথা মনে পড়বে। দিল্লি জামে মসজিদের আদলে বড় বড় পাথর ব্যবহার করে নির্মিত বলে এই মসজিদকে ‘পাথরের মসজিদ’ও বলা হয়।
ইতিহাসের নানা স্রোত বয়ে গেলেও মানুষের কাছে কখনো এই মসজিদের আবেদন কমেনি। পবিত্র রমজান মাসে এই মসজিদ রোজাদাররা সমবেত হন। হাজারো রোজাদারের জন্য ইফতারির আয়োজন করে মসজিদ কর্তৃপক্ষ। মসজিদের খতিবের একান্ত সহকারী মো. হাসান মুরাদ জানান, এই রমজানেও প্রতিদিন অন্তত দুই হাজার মুসল্লি ও রোজাদার এখানে ইফতার করছেন। রমজানের শেষ দিকে এই সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে যাবে।
১৮৫৩-৫৪ সালে ইংরেজ সরকারের কাছে মসজিদটি মুসলমানদের নামাজের জন্য ফেরত দিতে আবেদন জানান স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা। ১৮৮৫ সালে ১৯ নভেম্বর ইংরেজ সরকার এই মসজিদ আবারও ব্যবহারের অনুমতি দেয়
মসজিদের খতিব ছৈয়দ মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন তাহের জাবেরী আল-মাদানীর ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে এ ইফতারের আয়োজন করা হয় বলে জানান হাসান মুরাদ। তবে সহযোগিতায় রয়েছে মুসল্লি পরিষদ।
একসঙ্গে কত লোক নামাজ পড়ে—জানতে চাইলে হাসান মুরাদ বলেন, প্রতি ওয়াক্তে এই মসজিদে কয়েক হাজার মানুষ নামাজ পড়েন। তবে শুক্রবার জুমার নামাজ আদায় করেন প্রায় সাত হাজার মুসল্লি। রমজান মাসে পবিত্র জুমাতুল বিদার দিনে একসঙ্গে ৩০ হাজারের মতো মুসল্লি মসজিদে নামাজ আদায় করেন।