৯ মাসে শিশু অপহরণ মামলা ৬৯৫টি, উদ্ধার হয়নি ২৯%

শিশু অপহরণ ও জিম্মি মামলায় ৯ মাসে উদ্ধার হয়েছে ৪৯১ শিশু, অর্থাৎ ২৯ শতাংশ শিশু উদ্ধার হয়নি।

রাজধানীর হাজারীবাগে বাসার সামনে খেলছিল তাবাসসুম (৬) ও তাহসিন (২ বছর ৪ মাস) নামের দুই ভাই–বোন। বোরকা পরা এক নারী শিশুদের নানির সঙ্গে এসে আলাপ জমান। নানি শিশুদের রেখে বাসার ভেতরে গেলে ওই নারী শিশু দুটিকে দোকানে নিয়ে চিপস কিনে দেন। তাবাসসুম চিপস নিয়ে বাসায় ফিরলে ওই নারী তাহসিনকে কোলে নিয়ে চলে যান। ঘটনাটি চলতি বছরের ২১ মার্চের। সিসিটিভি ফুটেজে তাহসিন অপহরণের ওই ঘটনা ধরা পড়ে। শিশুটির বাবা নুরুল ইসলাম হাজারীবাগ থানায় সন্তান অপহরণের অভিযোগে মামলা করেন।

ওই সময় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন হাজারীবাগ থানার (এখন অন্য জেলায় বদলি) পুলিশ পরিদর্শক (এসআই) সাইফুল ইসলাম। ১১ নভেম্বর তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মামলাটি পরে গোয়েন্দা শাখায় (ডিবি) হস্তান্তর হয়। ঘটনার ১০ দিন পর ডিবি পুলিশ শিশু তাহসিনকে উদ্ধার করে।

৩ নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরির বিভাগের সামনের টয়লেটে বালতিভর্তি পানিতে আড়াই বছর বয়সী এক শিশুকে চুবাচ্ছিলেন এক নারী। এই দৃশ্য দেখে এক আনসার সদস্য শিশুসহ ওই নারীকে আটক করে মেডিকেল ক্যাম্পে নিয়ে আসেন। শিশুটির কান্নাকাটিতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওই নারী বালতির পানিতে চুবাচ্ছিলেন বলে জানান। ওই নারীর আচরণ অস্বাভাবিক মনে হওয়ায় শিশুসহ নারীকে মেডিকেল ক্যাম্প থেকে শাহবাগ থানার হেফাজতে দেওয়া হয়।

শিশুটির বিষয়ে এই প্রতিবেদক খোঁজ করতে ১৩ নভেম্বর শাহবাগ থানায় গেলে জানতে পারেন, ওই নারীর নাম মেরিনা আক্তার (২৮)। আর শিশুটির নাম মো. কাওসার। রাজধানীর ধলপুরে মা–বাবার অগোচরে শিশুটি বাসা থেকে গলিতে চলে এলে মেরিনা শিশুটিকে খাবার কিনে দিয়ে সঙ্গে নিয়ে চলে আসেন। পরদিন শিশুটির পরিবারের খোঁজ পাওয়া যায়। কাওসার লেদমিস্ত্রি মফিজুল ইসলাম ও মোসাম্মৎ বিলকিসের একমাত্র সন্তান।

কাওসারের চাচা ইমরান হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, অপহরণের ওই ঘটনায় এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তবে ওই নারী মানসিক প্রতিবন্ধী জানার পর তাঁরা মামলা করেননি।

শিশু অপহরণের এমন ঘটনা অহরহই ঘটছে। প্রতিরোধ করতে পারে না বলে সহজেই অপহরণের শিকার হয় শিশুরা। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, সারা দেশে শিশু অপহরণের ঘটনায় গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে থানায় ৬৯৫টি মামলা হয়েছে। অর্থ আদায়ের জন্য অপহরণ করে জিম্মি করার ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০–এর আওতায় এসব মামলা করা হয়। সরাসরি থানায় ও আদালত থেকে পাওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে থানায় শিশু অপহরণ ও পণবন্দীর (জিম্মি) মামলায় ৯ মাসে উদ্ধার হয়েছে ৪৯১ শিশু। অর্থাৎ ২৯ শতাংশ শিশু উদ্ধার হয়নি। উদ্ধার না হওয়া শিশুদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা এখনো জানা যায়নি।

পুলিশ সদর দপ্তরের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) ইনামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, যে মাসে মামলা হয়, এর পরের মাসগুলোয়ও অনেক শিশু উদ্ধার হয়। যেসব শিশু উদ্ধার হয়নি, সেই মামলাগুলো তদন্ত ছাড়া বলা সম্ভব নয় যে ওই শিশুদের সঙ্গে কী ঘটেছে বা কেন উদ্ধার হয়নি। তিনি আরও বলেন, শিশুরা প্রতিরোধ করতে পারে না বলে তারা অপরাধীদের সহজ লক্ষ্যে পরিণত হয়। পারিবারিক শত্রুতা, জিম্মি করে পরিবার থেকে মুক্তিপণ আদায়, পাচার ও যৌন নির্যাতনের উদ্দেশ্যে বিক্রি করার জন্য শিশু অপহরণের ঘটনা ঘটে।

মুনতাহাদের জন্য কান্না থামে না

তাহসিন ও কাওসারকে মা–বাবা ফিরে পেলেও সেই ভাগ্য হয়নি সিলেটের শিশু মুনতাহার (৫) মা–বাবা রামিমা বেগম ও শামীম আহমেদের। ৩ নভেম্বর মুনতাহা নিখোঁজের পর তার বাবা প্রথমে সাধারণ ডায়েরি (জিডি), পরে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে অপহরণে অভিযোগে মামলা করেন। ব্যক্তিগত বিরোধে প্রতিবেশীর মাধ্যমে হত্যার শিকার মুনতাহার লাশ উদ্ধার হয় ১০ নভেম্বর।

মুনতাহার ঘটনার ধাক্কা না সামলাতেই কানের দুলের জন্য যশোরের সাদিয়া খাতুনকে (৭) হত্যার ঘটনা প্রকাশ পেল। ১২ নভেম্বর দুপুরে নিখোঁজ হওয়ার পর রাতে সাদিয়ার লাশ উদ্ধার হয়। সাদিয়াকে হত্যার অভিযোগে ঝিকরগাছা থানা–পুলিশ আটক করেছে প্রতিবেশী নারী চম্পা খাতুনকে। চম্পার শিশুসন্তানের সঙ্গে ওই দিন খেলতে এসেছিল সাদিয়া।

১৫ নভেম্বর রাজধানীর আজিমপুরে মালামাল লুটের সঙ্গে বাড়ির আট মাস বয়সী শিশুটিকে অপহরণ করে নিয়ে যায় অপরাধী চক্র। পরে মোহাম্মদপুর থেকে শিশুটি উদ্ধার হয়। ১৩ নভেম্বর নোয়াখালী চাটখিল উপজেলা থেকে তিন বছরের এক শিশুকে মুক্তিপণের জন্য অপহরণ করেন খালা–খালু। এই শিশুও পরে উদ্ধার হয়।

অনেকের লাশ উদ্ধার হয়

নিখোঁজের ঘটনাও কোনো কোনো ক্ষেত্রে হত্যার ঘটনা হিসেবে প্রকাশ হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে লাশ উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে। চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল ঢাকা মহানগর পুলিশের ওয়েব পোর্টালে মারিয়া ইসলাম (৬) নামের এক শিশুর সন্ধান চাওয়া হয়। ওই সংবাদে বলা হয়, ১৪ এপ্রিল রাজধানীর দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে বসুন্ধরা রিভারভিউ এলাকার বাসা থেকে খেলার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে আর ফেরেনি শিশুটি। সন্তানকে খুঁজে না পেয়ে ঘটনার দিনই সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন মারিয়ার বাবা মো. মাসুদ রানা। এর কয়েক দিন পর একটি প্লটে পুঁতে রাখা অবস্থায় উদ্ধার হয় মারিয়ার লাশ।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (এখন অন্যত্র বদলি) এসআই মো. আবুল হাসান ১১ নভেম্বর প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবেশী এক কিশোর (১৪) শিশুটিকে ফাঁকা একটি প্লটে নিয়ে ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ পুঁতে রাখে। ওই কিশোর এখন টঙ্গীর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে আছে।

ফরিদপুরে বাড়ি থেকে কাউকে না বলে বেরিয়ে যাওয়া কিশোর আবরার জাওয়াদের (১৫) লাশ পুকুরে ভাসতে থাকা অবস্থায় উদ্ধার হয় ১২ নভেম্বর। আবরারের বাবা ভিয়েতনামপ্রবাসী। মা–বাবার একমাত্র সন্তান ছিল সে। মা–বাবার বিচ্ছেদের পর সে চাচার বাড়িতে থাকত।

আবরারের চাচা মার্শাল টিটু জানান, ১০ নভেম্বর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আবরারের খোঁজে পরদিন তিনি ফরিদপুর কোতোয়ালি থানায় জিডি করেন। ১১ নভেম্বর বিকেলে তাঁর মুঠোফোনে কল করে আবরার দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মানিকগঞ্জের হাসপাতালে আছে বলে পুলিশ পরিচয়ে সাত হাজার টাকা চান এক ব্যক্তি। ওই টাকা তাৎক্ষণিকভাবে মুঠোফোনে পাঠানো হয়। পরে সেই নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। পরদিন আবরারের লাশ পাওয়া যায়।

শিশু অপহরণের ঘটনা আলোচনায় এলে চট্টগ্রামের শিশু আলিনা ইসলাম আয়াতের (৬) কথা মনে পড়ে না এমন মানুষ কম আছেন। আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে হাসিমুখে দাঁড়ানো সেই আলিনার ছবি! ১৫ নভেম্বর আলিনা হত্যার দুই বছর হলো। ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ নেওয়ার উদ্দেশ্যে আলিনাকে অপহরণ করে প্রতিবেশী আবির আলী। অপহরণ ধামাচাপা দিতে আলিনাকে হত্যার পর লাশ ছয় টুকরা করে সাগরে ভাসিয়ে দেয় আবির, যাকে ‘চাচ্চু’ বলে ডাকত আলিনা।

মা সাহেদা আক্তার আর বাবা সোহেল রানা আলিনার স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান তার ছবি, খেলনা ও কাপড়চোপড়ের মধ্যে। আলিনার ছবি সব সময় সঙ্গে রাখেন বাবা সোহেল রানা। প্রথম আলোকে বললেন, ‘মেয়ের ছবি দেখি আর চোখের পানি ঝরে।’

শিশুদের প্রতি সংবেদনশীল আচরণের জন্য সচেতনতা সৃষ্টি করা দরকার বলে মনে করেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান ও পুলিশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অনেক সময় উদ্ধার না হওয়া শিশুরা হত্যার শিকার হয়েছে কি না, সেটাও জানা যায় না। লাশ উদ্ধার না হলে পুলিশ সেগুলো ‘নিখোঁজ’ লিখে দায়মুক্ত হয়ে যায়। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও ব্যবসায়িক বিরোধ থেকে শিশু অপহরণ করে হত্যা করা হয়।