ডেঙ্গুতে মৃত্যু: চিরতরে থেমে গেল রিফাহর ছবি আঁকা

গত ২৬ নভেম্বর ভিকারুননিসার শিক্ষার্থী রিফাহ নানজিবা ডেঙ্গুতে মারা গেছে। নভেম্বরে ডেঙ্গুতে রেকর্ড সংখ্যক ১৭৩ জনের মৃত্যু।

রিফাহ নানজিবা

রিফাহ নানজিবা পেনসিল দিয়ে গোলাপের কুঁড়ি এঁকেছে। চুলখোলা কোনো এক অচেনা কিশোরী শাড়ির কুঁচি সামলাতে ব্যস্ত—এমন ছবিও এঁকেছে। গোলাপের কুঁড়ি দেখে মনে হবে, এই ফুল ফুটল বলে। আর কিশোরীটি নিজেকে কল্পনা করেই এঁকেছিল কি না, তা আর জানার উপায় নেই। মাত্র তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া রিফাহ নানজিবার খাতা থেকে ছবি দুটি তুলে পাঠিয়েছেন তার বাবা মো. রায়হানুল হক।

গত ২৬ নভেম্বর রিফাহ নানজিবা ডেঙ্গুতে মারা গেছে। জ্বর আসা থেকে শুরু করে রিফাহ তার মা–বাবাকে মাত্র চার দিন সময় দিয়েছিল। মা ও বাবার আক্ষেপ—‘মেয়েটাকে চিকিৎসা করানোরও সুযোগ পেলাম না।’

রিফাহ ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ধানমন্ডি প্রভাতি শাখার তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। ধানমন্ডির একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় সে। সে পড়াশোনায় ভালো ছিল। সুন্দর ছবি আঁকত। নামাজ পড়ত।

রিফাহর মা শাহারিয়ার আক্তারের সময় কেটে যেত দুই মেয়েকে নিয়ে। রিফাহ আর তার ছোট বোন শোভাহা শাজনীন দুজনই ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ধানমন্ডি শাখার শিক্ষার্থী। শোভাহা পড়ছে প্রথম শ্রেণিতে।

গত বৃহস্পতিবার রায়হানুল হক মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, মিরপুর–১ নম্বরের বাড়িটি সাততলা, সেখানে মশা তেমন নেই। তবে মেয়েরা স্কুলে গেছে। স্কুলের কয়েকজন ডেঙ্গুতে আক্রান্তও হয়েছে এর আগে। এই বাবা বললেন, ‘আগে বলতাম আমার দুই মেয়ে, এখন বলতে হচ্ছে আমার এক মেয়ে। মেয়েকে দাফনের জন্য গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধায় গিয়েছিলাম। এর মধ্যে ছোট মেয়েটার শরীরটা গরম দেখে ঢাকায় চলে আসতে বাধ্য হয়েছি। ঢাকায় ফিরেই আগে মেয়ের ডেঙ্গু টেস্ট করিয়েছি। টেস্ট নেগেটিভ এসেছে। এখন বড় মেয়ের জন্য ধর্মীয় ও সামাজিক যেসব আনুষ্ঠানিকতা আছে তা শেষ করতে হবে।’

রিফাহ নানজিবার আঁকা ছবি

সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের এটুআইয়ের একজন কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করছেন রায়হানুল হক। তিনি জানান, মেয়ের জ্বর আসার পর প্রথমে ভাইরাস জ্বর ভেবেছিলেন। পরের দিনই ডেঙ্গু টেস্ট করান। ডেঙ্গু পজিটিভ হলেও এক দিনের মাথায় জ্বর থেমে যায়। তবে মেয়ে প্রচণ্ড পেটব্যথার কথা বলতে থাকে। চিকিৎসকের চেম্বারে নেওয়া হলে চিকিৎসক দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করতে বলেন। শ্যামলীর বাংলাদেশ শিশুস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে (শিশু হাসপাতাল নামে পরিচিত) ভর্তি করা হয়। সেখানে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে সিট না পাওয়ায় ধানমন্ডির আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকেরা চেষ্টায় কোনো ত্রুটি রাখেননি; কিন্তু মেয়ের প্রেশারে জটিলতা দেখা দেয়; প্রস্রাব হচ্ছিল না।

বড় মেয়ে রিফাহকে নিয়ে রায়হানুল হকের অনেক স্মৃতি। বললেন, ‘নিজের মেয়ে বলে বলছি না, আমাদের মেয়েটা ছিল একটা পরি, আল্লাহ সেই পরিটাকে নিয়ে গেছেন। মেয়েটা কোনো জিদ বা বায়না করত না। স্কুলে আমার মেয়ের জন্য কাঁদেনি এমন একটা বাচ্চাও পাওয়া যাবে না। সবাই ওকে খুব ভালোবাসত।’

মেয়েটা মারা যাওয়ার আগে খুব কষ্ট পেয়েছে উল্লেখ করে রায়হানুল হক বলেন, রাত আড়াইটার দিকে মেয়েটা বলে, তার খুব কষ্ট হচ্ছে। চিকিৎসকেরা পানি দিতে বারণ করেছেন। তাই রিফাহর মা পানি দিয়ে শুধু ঠোঁট ভিজিয়ে দিচ্ছিলেন। মেয়ে তৃপ্তি পাচ্ছিল না। বারবার বলছিল, এভাবে সে পানি খাবে না, ভালোভাবে পানি খেতে চায়। পরে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে তাকে গ্লাসে পানি খাওয়ানো হয়, কিছুটা সে তৃপ্তি পায়। তখন মা–বাবা যাতে তার পাশে থাকে, সে কথা বলতে থাকে। মেয়েটা ভেবেছিল, মা–বাবা চলে গেলেই চিকিৎসকেরা তাকে আর পানি খেতে দেবেন না। অস্থিরতায় বারবার মেয়ে তার মাথায় বাতাস দিতে বলে। পরে তো সব শেষ হয়ে গেল।

ডেঙ্গুতে নভেম্বরে ১৭৩ জনের মৃত্যু

দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে নভেম্বর মাসে এডিস মশাবাহিত রোগটিতে ১৭৩ জনের মৃত্যু হলো। চলতি বছর এখন পর্যন্ত এক মাসে সর্বোচ্চ মৃত্যু এটি। অক্টোবর মাসে ডেঙ্গুতে ১৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল।

গতকাল শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, গতকাল সকাল আটটা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এলাকার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।