বিতর্কিত তিনটি নির্বাচনের দায় পুলিশের ওপর চাপাল প্রশাসন

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় বিতর্কিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের জন্য নিজেদের তেমন একটা দায় স্বীকার করেননি প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

নির্বাচন বুথফাইল ছবি

২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য মোটা দাগে পুলিশের ওপর দায় চাপিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। ওই তিন নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন দায়িত্বে থাকা প্রশাসনের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের সঙ্গে আজ সোমবার জাতীয় সংসদ ভবনে মতবিনিময় সভা করেছে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন।

কমিশন সূত্র জানায়, সভায় ৩০ কর্মকর্তা অংশ নেন। তাঁদের মধ্যে বর্তমান প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারাও ছিলেন।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার নিয়ে প্রস্তাব তৈরির জন্য বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময় শুরু করেছে বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বাধীন নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। পাশাপাশি গত তিনটি নির্বাচনও পর্যালোচনা করছে তারা। এর অংশ হিসেবে সর্বশেষ তিনটি জাতীয় নির্বাচনে বিভিন্ন দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের সঙ্গে গতকাল মতবিনিময় সভা করল কমিশন।

২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন ‘বিনা ভোটের’ নির্বাচন হিসেবে পরিচিত। এই নির্বাচনে বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল অংশ নেয়নি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে নিবন্ধিত সব দল অংশ নেয়। তবে এই নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে হয়ে যায় বলে অভিযোগ ওঠে। যে কারণে ২০১৮ সালের নির্বাচন ‘রাতের ভোটের’ নির্বাচন হিসেবে বেশি পরিচিতি পায়। আর চলতি বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বলা হচ্ছে ‘ডামি নির্বাচন’। ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ব্যক্তিদের বেশির ভাগ ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা। যে কারণে তা ‘ডামি নির্বাচন’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এই নির্বাচনেও বিএনপিসহ অনেক দল অংশ নেয়নি।

এসব নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তখনকার ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার এবং সব জেলা প্রশাসক। সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ছিলেন মূলত তখনকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও)। গত তিনটি নির্বাচনে দায়িত্ব থাকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গেও সংস্কার কমিশন মতবিনিময় করবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সর্বশেষ তিনটি নির্বাচনে কীভাবে অনিয়ম হয়েছে, কেন কর্মকর্তারা নির্বাচনী অপরাধে জড়িয়েছেন, কীভাবে সামনে এসব এড়ানো যায়—মূলত এসব বিষয় বুঝতে কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করছে সংস্কার কমিশন। কিন্তু প্রশাসনের কর্মকর্তারা সবকিছুর জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষ করে পুলিশকে দায়ী করেছেন। নিজেরা তেমন একটা দায় স্বীকার করেননি। তাঁরা বলেন, ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল পুলিশ। তাদের ছত্রচ্ছায়ায় সব অনিয়ম হয়েছে। পুলিশ তখন প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কোনো নির্দেশনা আমলে নেয়নি; বরং কোনো নির্দেশনা দেওয়া হলে মাঠের পুলিশ কর্মকর্তারা সেটি পুলিশ সদর দপ্তরকে জানাতে বলতেন। অন্যদিকে মাঠপর্যায়ে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আদেশ মানতে হতো। সব মিলিয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তারা অসহায় ছিলেন। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের গাফিলতি ছিল।

তিনটি নির্বাচনে ভোটে অনিয়মের মূল দায় পুলিশের—প্রশাসনের কর্মকর্তাদের এমন অভিযোগের বিষয়ে পুলিশের বর্তমান প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের পাঁচ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে প্রথম আলো। কিন্তু তাঁরা বিষয়টি নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

এ বিষয়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনে অনিয়মের কোনো দায় পুলিশের নেই এমন নয়। তবে নির্বাচনে অনিয়মের মূল দায় পুলিশের ওপর চাপানোর বিষয়টি অতিরঞ্জিত অভিযোগ। নির্বাচনে অনিয়ম–কারচুপির দায় নিরূপণের ক্ষেত্রে দেখতে হবে রিটার্নিং অফিসার কে, প্রিজাইডিং অফিসার কে? কাদের প্রতিবেদনর পর নির্বাচন কমিশন ভোটের ফলাফল প্রকাশ করছে। ঢালাওভাবে পুলিশের ওপর দায় চাপানো ঠিক নয়।

‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প নেই’

প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা শেষে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার সাংবাদিকদের তিনি বলেন, প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেছেন, তাঁদের তেমন কিছু করার ছিল না। কলকাঠি নাড়ানো হয়েছে অন্য জায়গা থেকে। তখন রাষ্ট্র মূলত পুলিশি রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছিল, পুলিশি রাষ্ট্র হওয়ার কারণে এমন নির্বাচন হয়েছে। পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কোনো কথা শোনেনি। তখনকার মাঠপর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা তাঁদের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কর্মকর্তারা জানান, তাঁদের প্রতিবাদ করার কোনো সুযোগ ছিল না। একমাত্র পথ ছিল পদত্যাগ করা।

বদিউল আলম মজুমদার বলেন, মতবিনিময় সভায় প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। সুষ্ঠু নির্বাচন করতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো বিকল্প নেই। পরবর্তী নির্বাচনের জন্য আন্তবাহিনীগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বাড়াতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে আরও শক্ত অবস্থান নিতে হবে।

গতকালের মতবিনিময় সভায় প্রার্থীদের হলফনামার তথ্য যাচাই–বাছাইয়ের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে বলে জানান নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য মীর নাদিয়া নিভিন। তিনি জানান, প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেন, হলফনামার বিষয়টি আরও ভালোভাবে যাচাই করা সম্ভব। এ জন্য এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতা–সমন্বয় লাগবে। নির্বাচনের তফসিলে যাচাই–বাছাইয়ের সময় বাড়ানোর কথাও বলেছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।