বই পড়লে মনের দরজা খুলে যায়

অতিথি ও আয়োজকদের সঙ্গে পুরস্কারপ্রাপ্তরা। শনিবার রাজধানীর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরেছবি: প্রথম আলো

অবসরে বই পড়ার চেয়ে এখন শিক্ষার্থীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি সম্পৃক্ত থাকতে দেখা যায়। অভিভাবকেরাও ভালো ফলাফল করার প্রতিযোগিতায় সন্তানদের পাঠ্যবইয়ের বাইরে বই পড়তে দিতে আগ্রহী হন না। অথচ প্রকৃত জ্ঞানী হতে হলে বই পড়ার বিকল্প নেই। বই পড়া মানে মনের দরজা খুলে যাওয়া।

শনিবার বিকেলে রাজধানীতে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আয়োজিত ‘আলী যাকের মুক্তিযুদ্ধের গ্রন্থপাঠ উদ্যোগ-২০২৩’–এর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন।

একাত্তরের কণ্ঠযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, নাট্যজন ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি আলী যাকেরের স্মৃতি বহমান রাখতে গ্রন্থ পাঠের এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। এবার স্কুল–কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তিনটি গ্রন্থ পাঠ করে প্রতিক্রিয়া পাঠিয়ে পুরস্কার জিতেছেন ৩০ জন শিক্ষার্থী।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সমাপনী বক্তব্যে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর প্রয়াত আলী যাকেরের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, আলী যাকের নিজে প্রচুর বই পড়তেন। অন্যদেরও পড়ার উৎসাহ দিতেন। এখন জিপিএ-৫ পাওয়ার ‘নির্যাতনের’ মধ্য দিয়ে যাওয়ার কারণে ছেলেমেয়েদের মন শুকিয়ে যাচ্ছে। মন শুকিয়ে গেলে মগজ শুকিয়ে যায়। বড়রাই তরুণদের ইচ্ছাগুলোকে গলা টিপে মারছে। তিনি বলেন, বই পড়া মানে মনের দরজা-জানালা খুলে যাওয়া। সেই দরজা-জানালা দিয়ে বিশুদ্ধ বাতাস ও ফুলের সুবাস প্রবেশ করে। আর এভাবেই যুক্তিবাদী সমাজ গড়ে ওঠবে, যারা অন্ধভাবে কিছু বিশ্বাস করবে না।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর জানিয়েছে, তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ‘আলী যাকের মুক্তিযুদ্ধের গ্রন্থপাঠ’ উদ্যোগে যুক্ত হয়েছে ঢাকা মহানগরীর ১০টি বেসরকারি পাঠাগার। এই প্রতিষ্ঠানগুলো মিলে দনিয়া পাঠাগারের মোহাম্মদ শাহ নেওয়াজকে দলপ্রধান করে এই উদ্যোগ পরিচালনা করে। এই উদ্যোগে সহায়তা করেছে মঙ্গলদীপ ফাউন্ডেশন।

তিন মাস ব্যাপী বই পাঠের সূচনা হয় গত বছরের নভেম্বরে। পাঠাগারগুলো থেকে স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য আহসান হাবীব রচিত ‘৭১ এর রোজনামচা’, কলেজ পর্যায়ে শেখ তাসলিমা মুন রচিত ‘আমি একটি বাজপাখিকে হত্যা করতে চেয়েছিলাম’ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মাহমুদুল হক রচিত ‘জীবন আমার বোন’ বই পড়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে বলা হয়। সারা দেশের ৪৬টি পাঠাগার থেকে শিক্ষার্থী সদস্যরা অংশ নেন। তাঁদের কাছ থেকে ৫৪৮টি প্রতিক্রিয়া জমা হয়।

জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক মিনার মনসুর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মিল্টন কুমার দেব এবং এভারেস্টজয়ী পর্বতারোহী নিশাত মজুমদারকে নিয়ে জুরিবোর্ড গঠন করা হয়। পাঠ প্রতিক্রিয়া যাচাই–বাছাইয়ে সমকালের সাংবাদিক আবু সালেহ রনি, জনকণ্ঠের সাংবাদিক মোরসালিন মিজান ও ভোরের কাগজের সাংবাদিক ঝর্ণা মনিকে নিয়ে গঠন করা হয় প্রাথমিক নির্বাচক কমিটি। সেরা ৩০ শিক্ষার্থীকে পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয় সনদ, পাঁচ হাজার টাকার বই ও নগদ পাঁচ হাজার টাকা।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, এখন ধর্মান্ধতা এত বেশি বেড়েছে যে বই পড়া ও সাংস্কৃতিক চর্চা কমে যাচ্ছে। পাড়ায় পাড়ায় এখন আর আগের মতো এসব উদ্যোগ নেওয়া হয় না। অন্ধকার থেকে উত্তরণের জন্য বই পড়া ও সাংস্কৃতিক চর্চা বাড়াতে হবে।

সূচনা বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারওয়ার আলী বলেন, প্রকৃত জ্ঞানী হতে হলে, সমাজকে বুঝতে হলে গ্রন্থ পাঠের বিকল্প নেই। সমাজে রক্ষণশীলতা, ধর্মান্ধতা ও আত্মকেন্দ্রিকতার যে বীজ বপন হয়েছে, তা থেকে রক্ষা পেতে হলে গ্রন্থ পাঠ করতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আরেক ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, সমাজে একধরনের হাহাকার রয়েছে যে তরুণেরা বইবিমুখ হয়ে পড়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সেখানে ভূমিকা রাখতে চাইছে। এই উদ্যোগের সঙ্গে থাকা তরুণদের অন্তরে আলী যাকের স্থান করে নেবেন।
আলী যাকেরের স্ত্রী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সারা যাকের ছেলেমেয়েদের বই পড়তে উৎসাহ দিতে পরিবারকে বড় ভূমিকা রাখার ওপর জোর দেন।

তরুণদের বই পড়তে উৎসাহ দিতে অনুষ্ঠানে আলী যাকেরের ছেলে ইরেশ যাকের বলেন, এখন তরুণদের বই কম পড়া হচ্ছে, টিকটক দেখা হচ্ছে বেশি। যাঁরা বই পড়েন, তাঁরা ‘পাগল’। তাঁর বাবার বই পড়ার ‘পাগলামি’ ছিল। যাঁরা সংবেদনশীল, সহনশীল ও প্রগতিশীল সমাজ দেখতে ভালোবাসেন, তাঁদের জন্য এই ‘পাগলামির’ দরকার আছে।
জুরিবোর্ডের সদস্য হিসেবে নিশাত মজুমদার বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক বইগুলোর কোনো একটি বিষয়ও যদি শিক্ষার্থীদের জ্বলে উঠতে সহায়তা করে, তবে সেটাই হবে এই উদ্যোগের সার্থকতা।

জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক মিনার মনসুর বলেন, আলী যাকের বাতিঘর হিসেবে সমাজকে আলোকিত করেছেন। এই বই পড়া কার্যক্রম একটি সাংস্কৃতিক লড়াই। তরুণদের পড়ার ক্ষুধা আছে, কিন্তু সে চাহিদা মেটানো হচ্ছে না। পরিবার ও সমাজকে এই দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসতে হবে।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন আলী যাকের মুক্তিযুদ্ধের গ্রন্থপাঠ উদ্যোগের সমন্বয়কারী মোহাম্মদ শাহ নেওয়াজ ও নির্বাচক কমিটির পক্ষে ভোরের কাগজের সাংবাদিক ঝর্ণা মনি। পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেরা তিনজন প্রতিক্রিয়া জানান। তাঁরা হলেন স্কুল পর্যায়ে পাবনার অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরির ফারিয়া ইসলাম, কলেজ পর্যায়ে ঢাকার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি পাঠাগারের ইহসানুল হক এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে জামালপুরের ভাষা ও স্বাধীনতা সংগ্রামী মতি মিয়া ফাউন্ডেশন পাঠাগারের ইশরাত জাহান।

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ব্যবস্থাপক (কর্মসূচি) রফিকুল ইসলাম। অনুষ্ঠানের শুরুতে গান পরিবেশন করেন প্রমীলা বিশ্বাস। আসাদুজ্জামানের নূরের কণ্ঠে কামালউদ্দিন নীলুর লেখা ‘কুনঠে বাহে’ আবৃত্তির সঙ্গে আলী যাকেরকে নিয়ে তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। অনুষ্ঠান শেষে বিভিন্ন গ্রন্থাগারের সদস্যরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করেন।