ফেনীতে চাঁদার দাবিতে উন্নয়নকাজ বন্ধ, এক্সকাভেটরে আগুন
ফেনীর ফাজিলপুর ইউনিয়নের ফাজিলপুর-বটতলি-আর বি হাট সড়কে ২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে সংস্কারকাজ চলছিল। প্রকল্পের কাজ চলার সময় ঠিকাদারের কাছে চাঁদা দাবি করা হয়েছিল। চাঁদা না পেয়ে সড়কের কাজ বন্ধের পাশাপাশি ঠিকাদারের ৬০ লাখ টাকা দামের এক্সকাভেটরে (মাটি কাটার যন্ত্র) আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় ঠিকাদার আমজাদ হোসেনের প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ইমরুল হাবিব চৌধুরী ৭ ডিসেম্বর ফেনী মডেল থানায় মামলা করেন। মামলায় স্থানীয় ছাত্রদল ও যুবদলের কয়েকজন নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়।
মামলার এজাহারে বাদী ইমরুল হাবিব চৌধুরী উল্লেখ করেন, এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ মুরাদ সিদ্দিকী, কামরুল ইসলাম ভূঁইয়া, সজীবুল ইসলাম পাটোয়ারী, ইমাম সিদ্দিকী, মীর মোহাম্মদ আলী সবুজ ওরফে মীর সবুজ সড়কের সংস্কারকাজ শুরুর পর থেকে বিভিন্ন সময় চাঁদা দাবি করে আসছিলেন। চাঁদা না পেয়ে আসামিরা কাজ বন্ধ করে দেন। এরপর রাতের অন্ধকারে এক্সকাভেটরে আগুন দেন তাঁরা। এতে ৬০ লাখ টাকার এক্সকাভেটরটি পুড়ে যায়। মামলা দায়েরের আগে গত শুক্রবার সকালে কামরুল ইসলাম ভূঁইয়াকে পুলিশ আটক করে। পরে গতকাল শনিবার মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠায়।
মামলার আসামিদের মধ্যে কামরুল ইসলাম ভূঁইয়া সদর উপজেলা যুবদলের সদস্য, মীর মোহাম্মদ আলী সবুজ ওরফে মীর সবুজ সদর উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক, সজীবুল ইসলাম পাটোয়ারী জেলা যুবদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ইমাম সিদ্দিকী ফেনী সদর উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক।
এই মামলার প্রতিবাদে সদর উপজেলা যুবদল গতকাল সন্ধ্যা সাতটায় ফেনী শহরে প্রতিবাদ মিছিল করেছে। মিছিলে যুবদল নেতা কামরুল ইসলাম ভূঁইয়ার মুক্তি দাবি করা হয়। এ ছাড়া অন্য আসামিদেরও মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়।
ফাজিলপুর ছাড়া ফেনী জেলার বেশ কয়েকটি স্থানে সড়ক সংস্কারের কাজ বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে কেবল সদর উপজেলার ধলিয়া ইউনিয়নেই তিনটি উন্নয়নকাজ বন্ধ হয়ে গেছে। ওই সব প্রকল্পের কাজ পেয়েছিল আওয়ামী লীগ নেতাদের মালিকানাধীন ঠিকাদারি সংস্থা। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে ছিলেন অন্য ঠিকাদারেরা। কাজ বন্ধ করার জন্য তাঁদের হুমকি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
ধলিয়া স্কুলের পাশের সড়কে আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে সড়কের রক্ষাদেয়াল নির্মাণ, মাটি ভরাট ও সম্প্রসারণের কাজ চলছিল। এই প্রকল্পের কাজ পেয়েছিল যুবলীগের নেতা নুরুল হুদা মিস্টারের মালিকানাধীন মেসার্স স্বাধীন করপোরেশন। ওই প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজটি করছিলেন শওকত হোসেন। তিনি বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বন্যার কারণে নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু হয়নি। গত ১৭ নভেম্বর কাজ শুরু হয়। এ সময়ে করা ৬০ মিটার রক্ষাদেয়াল রাতের অন্ধকারে ভেঙে দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। এর আগে তিনি মুঠোফোনে একাধিকবার কাজ বন্ধ করার হুমকি পেয়েছেন বলে প্রথম আলোকে জানান।
ওই ইউনিয়নেরই ধলিয়া মোহাম্মদপুর-সাড়াশিয়া সড়কে হক ট্রেডার্স নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আড়াই কোটি টাকার উন্নয়নকাজ বন্ধ হয়ে গেছে। একই ইউনিয়নে ধলিয়া-রাজামিয়া সড়কের ৮০ লাখ টাকার উন্নয়নকাজও বন্ধ। এই সড়কের কার্পেটিংয়ের ৮৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের কাজ করছিল ফেনী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা শুসেন চন্দ্র শীলের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গণহত্যার একাধিক মামলার পলাতক আসামি। দুটি কাজ বন্ধের জন্য ঠিকাদারেরা হুমকি পেয়েছেন বলে প্রথম আলোকে জানান।
কেন এক ইউনিয়নে তিনটি উন্নয়নকাজ বন্ধ জানতে চাইলে ধলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা যুবদলের সভাপতি জাকির হোসেন বলেন, ধলিয়ায় সড়কের রক্ষাদেয়াল যারা ভেঙেছে, তাদের সঙ্গে যুবদল বা দলীয় অন্য কারও সম্পৃক্ততা নেই। চলমান ওই কাজ দাগনভূঞার উপজেলা যুবলীগ নেতা হত্যা মামলার আসামি মিস্টারের। তিনি পলাতক থাকায় কাজটি এলজিইডি অফিসের এক কর্মচারীর স্বজনকে দিয়ে করানো হচ্ছে। হামলা বা লুটের কোনো ঘটনা এখন পর্যন্ত তাঁকে কেউ জানাননি।
জাকির হোসেন আরও বলেন, গত ৫ আগস্টের আগে যাঁরা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সভা–সমাবেশে উপস্থিত থাকতেন, তাঁরা এখন নিজেদের বিএনপির কর্মী হিসেবে এলাকায় পরিচয় দিচ্ছেন এবং অপকর্ম করছেন। যুবদলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ থাকলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশে তাঁদের বিরুদ্ধে দলীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে জেলা বিএনপির সদস্যসচিব আলাল উদ্দিন আলাল বলেন, বিএনপির বিরুদ্ধে এভাবে ঢালাও অভিযোগ দেওয়া ঠিক নয়। বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন লোকজন ঝামেলা করলেও সেই দায় বিএনপির কাঁধে চাপানো হচ্ছে। যদি বিএনপি বা অঙ্গসংগঠনের কোনো নেতার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তবে দলীয় পদ থেকে তাঁদের বহিষ্কার করা হবে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ফেনীর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মাহমুদ আল ফারুক বলেন, ধলিয়া ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি কাজ স্থানীয় প্রতিবন্ধকতার কারণে বন্ধ রয়েছে। ফাজিলপুরে এক্সকাভেটরে আগুন দিলেও সেই কাজটি এক দিন বন্ধ থাকার পর আবার শুরু হয়েছে।
ফেনী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মর্ম সিংহ ত্রিপুরা বলেন, ধলিয়ায় সড়কের কাজের প্রতিবন্ধকতার কোনো অভিযোগ থানায় জমা পড়েনি। লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া ফাজিলপুরে এক্সকাভেটর পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় এখন পর্যন্ত একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। অপর আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে।