চট্টগ্রাম ওয়াসায় ‘ক্ষমতার জোরে’ টিকে আছেন ফজলুল্লাহ

ফজলুল্লাহ

দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে দায়িত্ব পালন করছেন এ কে এম ফজলুল্লাহ। তাঁর আমলে পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশনের জন্য একের পর এক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কোনোটিই তিনি নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে পারেননি। ব্যয় বেড়েছে দফায় দফায়।

আবার পানি চুরি, বছর বছর দাম বাড়ানো, অপচয় কমাতে না পারা ও দুর্নীতির অভিযোগ আসায় বারবার সমালোচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ–ঘনিষ্ঠ ৮১ বছর বয়সী এই প্রকৌশলী। কিন্তু ‘ক্ষমতার জোরে’ এখনো তিনি টিকে আছেন। গত বছরের আগস্টে তাঁকে অষ্টমবারের মতো এমডি পদে নিয়োগ দেয় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পতন হওয়া আওয়ামী লীগ সরকার।

১৯৪২ সালে জন্ম নেওয়া এ কে এম ফজলুল্লাহ চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে অবসর নেন ২০০০ সালে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ৬ জুলাই প্রথমবার চট্টগ্রাম ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে এক বছরের জন্য নিয়োগ পান। এরপর আরও এক বছর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১১ সালে ঢাকা ওয়াসার আদলে চট্টগ্রাম ওয়াসাতেও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ তৈরি করা হয়। ওয়াসা বোর্ডও পুনর্গঠন করা হয়। তখন এমডি পদে নিয়োগ পান তৎকালীন চেয়ারম্যান এ কে এম ফজলুল্লাহ। সেই থেকে এমডি পদে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

ওয়াসার বর্তমান ও সাবেক দুই বোর্ড সদস্য বলছেন, এ কে এম ফজলুল্লাহর সঙ্গে বিগত সরকারের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তাঁদের নানাভাবে কাজে লাগিয়ে তিনি বছরের পর বছর এই পদে ছিলেন। এ ছাড়া ওয়াসা বোর্ডও তাঁর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

এ কে এম ফজলুল্লাহ ওয়াসার আলোচিত কর্মকর্তা। তাঁর আমলে পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা গড়ে তুলতে অন্তত ১০টি প্রকল্প নেওয়া হয়। আটটি প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। দুটি বড় প্রকল্পের কাজ এখনো চলছে। শেষ হওয়া আট প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৮ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। আর চলমান দুই প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ৫ হাজার ৮০২ কোটি টাকা। একের পর এক প্রকল্প নিলেও নগরে পানির সংকট কাটেনি। প্রকল্পের সুফল নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন।

ওয়াসার বর্তমান ও সাবেক দুই বোর্ড সদস্য বলছেন, এ কে এম ফজলুল্লাহর সঙ্গে বিগত সরকারের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তাঁদের নানাভাবে কাজে লাগিয়ে তিনি বছরের পর বছর এই পদে ছিলেন। এ ছাড়া ওয়াসা বোর্ডও তাঁর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

তাঁকে নিয়ে যত বিতর্ক

নিজের বেতন-ভাতা বাড়ানোর আবদার করে এ কে এম ফজলুল্লাহ সমালোচিত হয়েছিলেন। ওয়াসার নথিপত্র অনুযায়ী, এ কে এম ফজলুল্লাহর মূল বেতন নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। বাড়িভাড়া, চিকিৎসা, আপ্যায়ন, বিশেষ ভাতাসহ মিলিয়ে মোট পান ৩ লাখ ১৭ হাজার টাকা, যা ২০১৬ সালের মে মাস থেকে কার্যকর হয়।

২০২২ সালের জানুয়ারিতে তিনি একলাফে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা বা ১৫০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির আবেদন করেছিলেন। অর্থাৎ মোট সাড়ে চার লাখ টাকা মূল বেতন চেয়েছিলেন। এ আবেদনের পর বোর্ড সদস্যরা বিস্ময় প্রকাশ করেন। পরে সমালোচনার মুখে তিনি বেতন বাড়ানোর আবেদন প্রত্যাহার করে নেন।

ওয়াসার বোর্ড সদস্য, কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীরা বলছেন, কোনো সমালোচনাকেই পাত্তা দেন না এমডি। আফ্রিকার দেশ উগান্ডার বেশির ভাগ মানুষ নিরাপদ পানি থেকে বঞ্চিত। সেখানে উন্নত পয়োনিষ্কাশন–সুবিধা নেই। অথচ এমডির আমলেই ৪১ কর্মকর্তা-কর্মচারী উগান্ডায় প্রশিক্ষণের জন্য গিয়েছিলেন। এ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হলেও গায়ে মাখেননি কেউ।

সূত্র জানায়, বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধের বিষয়ে ২০২২ সালের ১২ মে পরিপত্র জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়। কিন্তু ওই নির্দেশনা আসার পরও এমডিসহ চার কর্মকর্তা প্রশিক্ষণের নামে যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান। এ নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়। এ ছাড়া গত ১৫ বছরে বিভিন্ন সময়ে তিনি তুরস্ক, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে সফরে গেছেন। কখনো প্রশিক্ষণ, কখনো পরিদর্শনের কাজে সফর করেন তিনি।

দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে এ কে এম ফজলুল্লাহ সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি অবৈধভাবে একটা টাকাও আয় করেননি। তাঁর বিরুদ্ধে দুদক তদন্ত করেও কোনো অনিয়ম পায়নি।

এ কে এম ফজলুল্লাহর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছিল। ২০২০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তাঁর নামে দুদক চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক বরাবর দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ করেছিলেন চট্টগ্রামের বাসিন্দা হাসান আলী। পরে ২৩ সেপ্টেম্বর অভিযোগের বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তা জানতে চেয়েছিলেন হাইকোর্ট। আদালতের ওই পদক্ষেপের পর ওয়াসা ভবনের একটি কক্ষে রহস্যজনকভাবে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আগুনে কম্পিউটার, গুরুত্বপূর্ণ নথি পুড়ে যায়। এরপর অভিযোগ ওঠে, এমডির দুর্নীতি ঢাকতে ইচ্ছাকৃতভাবে ওই আগুন লাগানো হয়েছিল।

দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে এ কে এম ফজলুল্লাহ সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি অবৈধভাবে একটা টাকাও আয় করেননি। তাঁর বিরুদ্ধে দুদক তদন্ত করেও কোনো অনিয়ম পায়নি।

গত প্রায় ১৫ বছরে এ কে এম ফজলুল্লাহর প্রশ্রয়ে ওয়াসায় নিয়োগ ও পদোন্নতির সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন গাড়িচালক মো. তাজুল ইসলাম। চট্টগ্রাম ওয়াসা শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক পদে প্রায় ১৩ বছর ধরে আছেন তাজুল ইসলাম। এমডির আস্থাভাজন হয়ে ১৫ বছর ধরে ওয়াসায় নিয়োগ-বাণিজ্য চালিয়ে গেছেন। তাজুল চট্টগ্রাম নগরে পাঁচতলা বাড়ি করেছেন। এ নিয়ে দুদকে মামলাও হয়েছে। এ ছাড়া তাজুলের ভাই, বোন, শ্যালক, ভাতিজা, ছেলে, ভাগনেসহ অন্তত ১২ জন নিকটাত্মীয়কে ওয়াসায় চাকরি দিয়েছেন এমডি। তাজুলের বিষয়ে এমডির বক্তব্য, তিনি কাউকে কোনো ধরনের প্রশ্রয় দেননি।

অপচয় কমাতে প্রকল্প, ফল নেই

চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রতিদিন গড়ে ৪৫ থেকে ৫০ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করে। কিন্তু উৎপাদনের সব পানি গ্রাহকের কাছে পৌঁছায় না। ৩০ শতাংশ পানি কারিগরি অপচয়ের নামে নষ্ট হয়। এই অপচয় কমাতে ২০১৪ সালে একটি প্রকল্প নেয় সংস্থাটি। ৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হয় ২০১৯ সালে। ফুটো মেরামত, ফ্লো মিটার স্থাপন ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের নামে এই টাকা খরচ করা হয়। কিন্তু পানির অপচয় কমাতে পারেননি এমডি।

ওয়াসার কর্মকর্তাদের অভিযোগ, প্রকল্পের সুফল গ্রাহকেরা পাননি। কারিগরি অপচয় কমেনি। উল্টো বেড়েছে। কাগজপত্র অনুযায়ী, ২০১৯ সালে মোট উৎপাদনের ২৫ শতাংশ পানি অপচয় হয়। আর প্রকল্প শেষে ২০২০ সালে অপচয়ের পরিমাণ ছিল ২৮ শতাংশ। তবে প্রকল্প নিয়ে গুটিকয় কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন এমডি এ কে এম ফজলুল্লাহ।

বর্তমানে পাইপের ফুটোর কারণে প্রতিবছর অন্তত ৯১২ কোটি লিটার পানি নষ্ট হচ্ছে। নষ্ট হওয়া পানির দাম প্রায় ২৫ কোটি টাকা। আবার এই ফুটো সারাতে বছরে গড়ে খরচ হয় এক কোটি টাকার বেশি। দেশে ঢাকা, রাজশাহী ও খুলনা ওয়াসায় ‘সিস্টেম লস’ চট্টগ্রামের চেয়ে কম। ঢাকা ওয়াসার সিস্টেম লস ২০ শতাংশ, রাজশাহী ওয়াসায় ২৯ শতাংশ ও খুলনা ওয়াসায় ২৪ শতাংশ।

এমডির ঘোষণা কাগজে-কলমে

২০১৬ সালের ১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পোমরা এলাকায় কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প এলাকায় সংবাদ সম্মেলনে এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেছিলেন, ‘২০২০ সালের মধ্যে চট্টগ্রামবাসী দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা নিরাপদ পানি পাবেন।’

ওই ঘোষণা আলোর মুখ দেখেনি। এখনো প্রতিদিন ঘাটতি রয়েছে ১২ থেকে ১৫ কোটি লিটার পানি। এ নিয়ে গ্রাহকেরাও ক্ষুব্ধ।

জানা গেছে, পানির সংকট কাটাতে না পারলেও দাম ঠিকই বাড়িয়ে দিয়েছেন এ কে এম ফজলুল্লাহ। তাঁর আমলে প্রায় প্রতিবছরই পানির দাম বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ গত মার্চে আবাসিকে ৩০ শতাংশ ও বাণিজ্যিকে ৫০ শতাংশ পানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন এমডি। এ জন্য কমিটিও করে দিয়েছিলেন তিনি। অথচ গ্রাহকের কাছে পানি বিক্রি করে প্রতিবছরই কোটি কোটি টাকা লাভ করে সংস্থাটি।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি তিন বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রথম পয়োনিষ্কাশন প্রকল্পের কাজ শেষ না হলেও একই ধরনের আরও পাঁচটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

প্রকল্পে ধীরগতি

এ কে এম ফজলুল্লাহ ২০১১ সালে এমডি হওয়ার পর পানি সরবরাহে চারটি বড় প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পগুলো হলো, কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প (প্রথম পর্যায়), কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়), চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন ও পয়োনিষ্কাশন প্রকল্প (সিডব্লিউএসআইএসপি) ও ভান্ডারজুরী পানি সরবরাহ প্রকল্প। ঋণের টাকায় নেওয়া এ চার প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ১০ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। কোনোটিই নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি। দুটিতে ব্যয় বেড়েছে ১ হাজার ৭১২ কোটি টাকা। এর মধ্যে সিডব্লিউএসআইএসপি ও ভান্ডারজুরী পানি সরবরাহ প্রকল্পের ঠিকাদার হলো দক্ষিণ কোরিয়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তেইয়ং ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড।

অন্যদিকে নগরে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে ২০১৮ সাল থেকে ৩ হাজার ৮০৮ কোটি ব্যয়ের একটি প্রকল্পের কাজ করছে ওয়াসা। পাঁচ বছরে কাজের অগ্রগতি ৫৬ শতাংশ। ২০২৬ সালের আগে কাজ শেষ হবে না। ব্যয়ও বাড়বে। এ প্রকল্পের ঠিকাদারও তেইয়ং। অর্থাৎ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি তিন বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রথম পয়োনিষ্কাশন প্রকল্পের কাজ শেষ না হলেও একই ধরনের আরও পাঁচটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

প্রকল্পের ধীরগতির বিষয়ে এ কে এম ফজলুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পের নকশা, অনুমোদন থেকে শুরু করে দরপত্র আহ্বান, জমা ও মূল্যায়ন পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপ পার হতে হয়। এসব প্রক্রিয়া মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) মাধ্যমে অনুমোদন নিতে সময় বেশি চলে গেছে।

জানতে চাইলে সনাক-টিআইবির চট্টগ্রাম নগরের সভাপতি আখতার কবির চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এ কে এম ফজলুল্লাহ প্রতিটি প্রকল্প থেকে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন, এমন কথা দীর্ঘদিন ধরে শোনা যাচ্ছে। প্রকল্প ব্যয় থেকে একটা অংশ কীভাবে নিয়োগকর্তাদের দেওয়া যায়, সে কৌশল তিনি ভালোভাবেই জানেন। তাঁর সম্পদ নিয়ে দুদকের তদন্ত করা উচিত।

আখতার কবির চৌধুরী আরও বলেন, তাঁর সময়ে নগরে পানির সংকট কাটেনি। উল্টো পানির মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। দফায় দফায় পানির দামও বেড়েছে। অথচ বিগত সরকার তাঁকে সরায়নি।