বন্যার কথা বলতে গিয়ে চোখ ভিজে উঠল ফেনীর বিবি সখিনার

বিবি সখিনাছবি: প্রথম আলো

তিন কক্ষের ছোট টিনশেড ঘর। ফুটো চাল। কাঠের জানালা ভেঙে পড়েছে। ঘরের ভেতরে হাঁটুপানি। ফ্রিজ, লেপ-তোশক, জামাকাপড় ও আসবাব পড়ে আছে পানিতে। ভাসছে থালাবাসন। এর মধ্যে বিবি সখিনা তাঁর দুই ছেলেকে নিয়ে সোফাগুলো ঘর থেকে বের করে আনার চেষ্টা করছিলেন।

আরও পড়ুন

বিবি সখিনার বাড়ি ফেনী সদরের ফাজিলপুর ইউনিয়নের পুর্বালী গ্রামে। গতকাল সোমবার দুপুর ১২টায় যখন তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখন ঘরের উঠানে বুকসমান পানি ছিল। পঞ্চাশোর্ধ্ব এই মা তাঁর দুই ছেলের সঙ্গে ঘরের জিনিসপত্রগুলো বের করে আনার চেষ্টা করছিলেন। বন্যার প্রভাব সম্পর্কে বিবি সখিনা বলেন, ২১ আগস্ট সকালে ঝুম বৃষ্টি হয়। তখন বিভিন্ন এলাকায় পানি ওঠার খবর তাঁরা পেয়েছিলেন। পরে দুপুরের দিকে উঠানে গোড়ালি পরিমাণ পানি জমে যায়। বেলা একটার পর হঠাৎ ঢলের মতো করে পানি আসতে থাকে। ২০ থেকে ২৫ মিনিটের মধ্যে তাঁদের ঘরের ভেতর হাঁটুপানি জমে যায়।

তখন ঘরের উঠানে বুকসমান পানি ছিল। পঞ্চাশোর্ধ্ব এই মা তাঁর দুই ছেলের সঙ্গে ঘরের জিনিসপত্রগুলো বের করে আনার চেষ্টা করছিলেন।

ঘরে পানির ঢোকার পর বিবি সখিনার মনে হয়েছিল, এর বেশি পানি হবে না; কিন্তু তা হয়নি। বেলা তিনটার মধ্যে হু হু করে পানি বাড়তে থাকে। চারদিকে শোরগোল পড়ে যায়। শিশুদের কোলে নিয়ে গ্রামের নারী-পুরুষেরা সড়কের দিকে দৌড়াতে থাকেন। একপর্যায়ে রাস্তায় বুকসমান পানি জমে যায়। ভয় পেয়ে যান সবাই। বিবি সখিনা বলেন, ঘর থেকে এক কাপড়ে বের হয়ে তাঁরা স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় গিয়ে আশ্রয় নেন। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুপুর ১২টা থেকে বেলা ৩টা—মাত্র তিন ঘণ্টায় গ্রামের পরিবেশ পাল্টে যায়।

আরও পড়ুন

বিবি সখিনা বন্যার কথা বলার সময় মুষড়ে পড়েন। চোখ ভিজে ওঠে তাঁর। তিনি বলেন, ‘মাটিতে মিশে গেলাম। কোনো জিনিস বাঁচাতে পারিনি। কিস্তিতে ফ্রিজ ও টিভি কিনেছিলাম। সব শেষ।’

শিশুদের কোলে নিয়ে গ্রামের নারী-পুরুষেরা সড়কের দিকে দৌড়াতে থাকেন। একপর্যায়ে রাস্তায় বুকসমান পানি জমে যায়। ভয় পেয়ে যান সবাই।

সখিনার স্বামী মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। তাঁর তিন ছেলে। বড় ছেলে নুরুল আবসার বছর তিনেক আগে বিয়ে করেছেন। বাকি দুই ছেলের একজন রংমিস্ত্রি, অন্যজন বেকার। নুরুল আবসার প্রথম আলোকে বলেন, গ্রামে ছোটখাটো একটা মুদিদোকান চালিয়ে সংসার চালান তিনি। অন্য ভাইয়েরা তেমন সহযোগিতা করতে পারেন না। তাঁকে পরিবার সামলাতে হয়। এ বছরের মধ্যে ঘরের মেঝে সিমেন্ট দিয়ে ঢালাই দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন; কিন্তু এখন মাটিই সরে গেছে। এ ছাড়া ফ্রিজ ও টিভি ছয় দিন ধরে পানিতে ডুবে আছে। মনে হয় না আর মেরামত করা যাবে।

আরও পড়ুন

ছেলের কথা শুনে গুমরে গুমরে কাঁদেন বিবি সখিনা। কোনোমতে নিজেকে সামলে প্রথম আলোর এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে শুধু প্রাণটা বাঁচাতে পেরেছেন। প্রথম তিন দিন কোনো খাবারই জোটেনি। শুধু পানি খেয়ে ছিলেন। এখন ছেলেদের চোখের দিকে তাকাতে পারছেন না। কারণ অনেক কষ্ট করে জিনিসপত্র কিনেছিলেন তাঁরা।

মাটিতে মিশে গেলাম। কোনো জিনিস বাঁচাতে পারিনি। কিস্তিতে ফ্রিজ ও টিভি কিনেছিলাম। সব শেষ।
বিবি সখিনা