আট প্রবীণের মৃত্যুর সঙ্গে ভাষাটিরও মৃত্যু হবে

বান্দরবানের আলীকদমের ক্রাংসিপাড়ার রেংমিটচা ভাষা জানা সিংরা ম্রো (বাঁয়ে) ও কুনরাও ম্রো
ছবি: প্রথম আলো

রেংমিটচা নামের একটি ভাষা জানা আটজন মানুষ বান্দরবানে বসবাস করেন। তাঁদের বয়স ৫৬ থেকে ৭৬ বছর। থাকেনও ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়। প্রবীণ এই মানুষগুলোর পরিবারের আর কেউ জানেন না ভাষাটি। ভাষাবিদদের আশঙ্কা, তাঁদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেশ থেকে লোপ পাবে রেংমিটচা ম্রো জনগোষ্ঠীর বিলুপ্তপ্রায় এই ভাষা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জীবিত ‘আটজন’ রেংমিটচা ভাষা জানা প্রবীণ থাকলেও বর্তমানে রেংমিটচা ভাষাভাষী আর কোনো পরিবার নেই। যে আটজন কমবেশি এই ভাষা জানেন, তাঁরা আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার পাঁচটি পাড়ায় আলাদা পরিবারে বসবাস করেন। পরিবারের অন্য সদস্যরা না জানায় এই ভাষায় তাঁরাও কথা বলেন না।

রেংমিটচা ভাষা সংরক্ষণের উদ্যোগ হিসেবে ‘মিটচ্য তখক’ বা ‘রেংমিটচা ভাষা শব্দের বই’ প্রকাশ করেছেন গবেষক ইয়াংঙান ম্রো। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভাষাটি টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারি-বেসরকারিভাবে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। রেংমিটচা ভাষা ইতিমধ্যে মরে গেছে, আট প্রবীণের মৃত্যুর সঙ্গে ভাষাটিও শ্মশানে যাবে।

কমে যাচ্ছে রেংমিটচা জানা মানুষ

আলীকদম সদর ইউনিয়নের ক্রাংসিপাড়া রেংমিটচা ভাষাগোষ্ঠীর সবচেয়ে প্রাচীন পাড়া হিসেবে পরিচিত। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে ওই পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, ২৭টি ম্রো পরিবার সেখানে বসবাস করে। পাড়াবাসী সবাই জুমচাষি ও দরিদ্র। দুর্গম এই পাড়ায় কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। পাড়াবাসীর মধ্যে লেখাপড়া জানা মানুষ নেই।

আরও পড়ুন

রেংমিটচা জানাদের মধ্যে বর্তমানে চারজন এই পাড়ায় থাকেন। তাঁরা হলেন মাংপুন ম্রো (৭৬), সিংরা ম্রো (৫৬), কুনরাও ম্রো (৭০) ও কুনরাও ম্রো (৬৫) (দুজনই নারী ও একই নাম)। একই ইউনিয়নের মেনসিংপাড়ায় ৫৯ বছরের থোয়াইংলক ম্রো ও ক্রমতংপাড়ায় ৭২ বছরের নারী কাইবুং ম্রোর বসবাস। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারী ইউনিয়নের ওয়াইবতপাড়ায় ৭৩ বছর বয়সী মাংপুন ম্রো ও কাইংওয়াইপাড়ায় ৬২ বছরের মাংওয়ই ম্রো থাকেন।

কুনরাও ম্রো ও সিংরা ম্রো প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের ছোটবেলায় ক্রাংসিপাড়ায় ৪০-৪৫টি পরিবারের সবাই রেংমিটচাভাষী ছিলেন। এ ছাড়া ক্রংতমপাড়া, রানিইপাড়া ও কুইকীপাড়া নামের আরও তিনটি রেংমিটচা পাড়া ছিল। এই পাড়াগুলোতে শতাধিক রেংমিটচা ভাষার পরিবার বসবাস করত।

আশির দশকে জার্মান গবেষক ক্লাউস-ডিয়েটার ব্রাউনস ও লোরেন্স জি লোফলার আলীকদম এবং লামায় ম্রোদের জীবনধারা নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। তাঁদের লেখা ‘ম্রু, হিল পিপল অন দ্য বর্ডার অব বাংলাদেশ’ গ্রন্থে প্রথম রেংমিটচাভাষীদের তথ্য পাওয়া যায়। এই গ্রন্থের তথ্যের ভিত্তিতে ২০১৩ সালে গবেষণা করতে বাংলাদেশে আসেন যুক্তরাষ্ট্রের ডারমুথ কলেজের লিংগুস্টিকস অ্যান্ড কগনিটিভ সায়েন্সের শিক্ষক ডেভিড এ পিটারসন। তিনি ২০১৫ সালের ১১ জানুয়ারি বান্দরবানে সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, রেংমিটচা ভাষা জানা ৩০ জনকে তিনি খুঁজে পেয়েছেন। খুব দ্রুত এই ভাষার বিলুপ্তির আশঙ্কার কথা তুলে ধরেন তিনি। বর্তমানে তাঁদের কেবল আটজন জীবিত আছেন বলে জানিয়েছেন রেংমিটচাভাষী প্রবীণেরা।

নৃভাষাবৈজ্ঞানিক সমীক্ষায় পাওয়া দেশের ৪১টি ভাষার মধ্যে ১৪টি বিপন্ন হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে বান্দরবানের রেংমিটচা ও সিলেটের পাত্র জনগোষ্ঠীর লালেং ভাষা বিলুপ্তপ্রায় অবস্থায় পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক হাকিম আরিফ। তিনি বলেন, এই দুটি ভাষা সংরক্ষণ ও টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে লালেং ভাষা নিয়ে কিছু কাজ হয়েছে।

যেভাবে হারাচ্ছে রেংমিটচা

রেংমিটচা ম্রো জনগোষ্ঠী ও ভাষা নিয়ে কাজ করা গবেষকদের তথ্য অনুযায়ী, সতেরো শতকে আরাকান থেকে খুমিদের সঙ্গে ছোট একটি দল বান্দরবানে আসে। তারা ছিল রেংমিটচাভাষী। পরে তাঁরা মাতামুহুরী নদীর উজানের ম্রোদের সঙ্গে প্রায় মিশে যায়।
গবেষকদের মতে, রেংমিটচাভাষীরা একসময়ে আলাদা পাড়াগ্রামে স্বতন্ত্র ধারায় বসবাস, ভাষা ও সংস্কৃতিচর্চা করতেন। কিন্তু পরে রেংমিটচা পরিবারগুলো কমে গেলে ম্রোদের সঙ্গে বৈবাহিক বন্ধনসহ সামাজিকভাবে মিশে যেতে বাধ্য হন। প্রথমে নিজেদের স্বাতন্ত্রিক পারিবারিক আবহ হারিয়েছেন। পরে ভাষা থেকেও বিচ্যুত হয়েছেন।

রেংমিটচা জানা প্রবীণেরা বলছেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে (ব্রিটিশ-পাকিস্তান আমলে) কলেরা, গুটিবসন্ত রোগের মহামারি এবং ১৯৮০–এর দশকে অশান্ত পরিস্থিতি রেংমিটচাভাষী ও ভাষাকে সংকটে ফেলে দিয়েছে। ম্রো বসতিগুলোতে মাঝে মাঝে কলেরা ও বসন্ত ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে এবং বহু মানুষের মৃত্যু হয়। এর ফলে এমনিতে কম সংখ্যার রেংমিটচাভাষীর জনসংখ্যা আরও কমে যায়।

কুনরাও ম্রো বলেন, তিনি ছোটবেলায় দেখেছেন তাঁদের ক্রাংসিপাড়ায় কলেরায় ও গুটিবসন্তে বহু পরিবারের সবাই মারা গেছে। অনেক পরিবারের জীবিত সদস্যরা পালিয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ায় পাড়া প্রায় জনশূন্য হয়ে যায়। পরে পাড়ায় ম্রো ভাষার লোকজন এসে বসবাস শুরু করে। রেংমিটচা যারা ছিল তারাও ম্রোভাষীতে রূপান্তরিত হতে থাকে।

সিংরা ম্রো ও কুনরাও ম্রো বলেছেন, পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় তাঁরা ম্রো ভাষাগোষ্ঠীর সঙ্গে পরিবার গঠনে বাধ্য হয়। রেংমিটচা ভাষাও হারিয়ে যেতে যেতে বর্তমানে বিপন্ন অবস্থা থেকে মরণাপন্ন অবস্থায় চলে এসেছে।

আলীকদমের কুরুকপাতা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ক্রাতপুং ম্রো বলেছেন, মহামারি আকারে ম্রো পাড়াগেলোতে ছড়িয়ে পড়া কলেরা ও গুটিবসন্ত রেংমিটচা ভাষাগোত্রের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিয়েছে। কোনো ভাষাগোষ্ঠীর জনসংখ্যা কমে গেলে প্রথমে ভাষার পরিবার ভেঙে যায়। তখন শিশুরা মাতৃভাষা শেখার পরিবেশ পায় না। ধাপে ধাপে ভাষাটি বিপন্ন হয়ে বিলপ্তির দিকে চলে যায়। রংমিটচা ভাষাও সেভাবে শেষ বিলুপ্তি ধাপে এসেছে।

সামাজিক পরিবেশ তৈরির তাগিদ

ভাষাটি টিকিয়ে রাখতে হলে প্রথমে রেংমিটচা জানা প্রবীণদের মধ্যে নিজেদের ভাষায় কথা বলার সামাজিক পরিবেশ তৈরি করার তাগিদ দিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সৌরভ সিকদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দ্রুত ভাষার হরফ উদ্ভাবন করে ভাষা না–জানা এই ভাষাগোষ্ঠীর শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা দরকার। এতে ভাষার পরিসর ও ভাষা জানা সদস্যসংখ্যা বাড়লে ভাষাটি টিকে থাকার সম্ভাবনাও বাড়বে।