সাবেক মেয়রের আমলে চট্টগ্রাম সিটিতে উন্নয়নকাজ ভাগাভাগি, ঢালাও নিয়োগ
সাবেক মেয়র ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের টাকায় সাতটি দেশ ঘুরেছেন।
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই একের পর এক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিয়ম না মেনে ঠিকাদারদের ভাগাভাগি করে দেওয়া হয়েছে উন্নয়নকাজ। বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই বাসাবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও অফিস থেকে বর্জ্য সংগ্রহের কাজ দিয়েছেন পছন্দের ব্যক্তিদের। আবার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের টাকায় ঘুরেছেন বিভিন্ন দেশ। জনসংখ্যা ও আয়তনে পিছিয়ে থাকার পরেও নিজের ওয়ার্ডের উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি অর্থ বরাদ্দ দিয়েছেন। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো প্রশ্রয় দিয়ে গেছেন।
এত সব অনিয়ম ঘটেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অপসারিত মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর আমলে। তাঁর সময়ে গৃহকর বৃদ্ধির প্রতিবাদ করতে গিয়ে হামলা-মামলার শিকার হয়েছিলেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত একতরফা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে জয়ী হন নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরী। সব ওয়ার্ডে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত ও বিদ্রোহী প্রার্থীরা। অর্থাৎ পুরো পরিষদটাই ছিল সরকারদলীয়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে সাবেক মেয়রসহ প্রায় সব কাউন্সিলর আত্মগোপনে চলে যান। ইতিমধ্যে বিভিন্ন থানায় তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে।
ঢালাও নিয়োগ
জনবল কাঠামোয় অনুমোদিত পদের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে। এরপরও সাবেক মেয়রের আমলে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই দুই শতাধিক কর্মীকে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। গত বছরের ৩ অক্টোবর এক দিনেই নিয়োগ দেওয়া হয় অন্তত ৩০ জনকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে অস্থায়ী ভিত্তিতে লোক নিয়োগের সুযোগ নেই। তাই চতুর্থ শ্রেণির পদগুলোয় লোক নিয়োগ দেওয়া হয়। বিশেষ করে শ্রমিক, কর আদায়কারী, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক, সড়ক তদারককারী, সুপারভাইজার, অফিস সহকারী, সড়ক পরিদর্শক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁদের দৈনিক মজুরি ৪৫২ টাকা। তবে যেদিন কাজ করবেন না, এদিন কোনো মজুরি দেওয়া হবে না।
বিজ্ঞপ্তি ছাড়া লোক নিয়োগের ঘটনাকে ‘মারাত্মক অনিয়ম’ বলে মন্তব্য করেছেন সরকারি চাকরির বিধিবিধানের বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, জনগণের অর্থে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞপ্তি ছাড়া নিয়োগ মানেই হচ্ছে সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করা।
সিটি করপোরেশনের নথিপত্র ও বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে বিদ্যমান জনবল কাঠামো অনুযায়ী মোট পদ রয়েছে ৪ হাজার ২২৬। এসব পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ৮ হাজার ২৪৫ জন। অর্থাৎ বাড়তি লোকবল আছেন ৪ হাজার ১৯ জন।
কাজ ভাগাভাগি, মারধর
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ব্যয়ের প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। বিমানবন্দর সড়কসহ বিভিন্ন সড়ক উন্নয়ন ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত উন্নয়নে আড়াই হাজার কোটি টাকার কাজ চলছে। ২০২২ সালের অক্টোবরে এ প্রকল্পের প্রায় শতকোটি টাকার ২৫টি কাজ গণ খাতে ক্রয়বিধি (পিপিআর) না মেনে ঠিকাদারদের ভাগাভাগি করে দেয় সিটি করপোরেশন।
এভাবে কাজ ভাগাভাগির অভিযোগ ওঠায় প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। কাজ ভাগাভাগি বন্ধে, গুণগত মান বজায় রাখা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সিটি করপোরেশনের প্রকৌশলীর পরিবর্তে নতুন প্রকল্প পরিচালক হিসেবে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. গোলাম ইয়াজদানীকে দায়িত্ব দেয় মন্ত্রণালয়। তবে কাজ ভাগাভাগির আবদার না শোনায় তাঁর ওপর হামলা করেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ঠিকাদারেরা। এ ঘটনায় সিটি করপোরেশনের কর্মীদের ইন্ধন ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। গত বছরের ২৯ জানুয়ারি টাইগারপাসে সিটি করপোরেশনের অস্থায়ী প্রধান কার্যালয়ের কক্ষে ঢুকে প্রকল্প পরিচালককে মারধর করেন ঠিকাদারেরা। এরপর গত বছরের মে মাসে গোলাম ইয়াজদানীর পরিবর্তে আরেকজন প্রকৌশলীকে নতুন প্রকল্প পরিচালক করা হয়।
ময়লা সংগ্রহের কাজেও পছন্দের লোক
সাবেক মেয়রের আমলে নগরের বর্জ্য সংগ্রহের কাজ বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর এ কাজ পেয়েছেন তাঁর ও ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের পছন্দের লোক। বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই এখন পর্যন্ত চারটি ওয়ার্ডের কাজ দেওয়া হয় পছন্দের অনভিজ্ঞ ঠিকাদারদের।
নগরের ২৪ নম্বর উত্তর আগ্রাবাদের কাজ পেয়েছে সাবেক কাউন্সিলর ও বিদায়ী মেয়রের ঘনিষ্ঠ জাবেদ নজরুল ইসলামের মেসার্স পাওয়ার সোর্স। ২০২২ সালের এপ্রিলে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয় সিটি করপোরেশনের। আর সেপ্টেম্বরেই কাজ শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। এই প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। কাজ পাওয়ার পর জাবেদ নজরুল ইসলাম সাবেক মেয়রের সঙ্গে ভারতে যান। তাঁরা সেখানে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান। এরপর আরও পাঁচটি ওয়ার্ডে বর্জ্য সংগ্রহের কাজ দেওয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়েছিল। কিন্তু সরকার পতনের পর নথিপত্র চাপা পড়ে আছে।
পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ডের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পায় স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোবারক আলীর বন্ধু মোহাম্মদ জাহেদ হোসেন চৌধুরীর প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট প্রাইভেট সার্ভিস। মোবারক আলী বর্জ্য ব্যবস্থাপনাবিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি। শুলকবহর ওয়ার্ডে কাজ পেয়েছে ক্লিন-গ্রিন ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট সার্ভিস এবং চান্দগাঁও ওয়ার্ডের কাজ পায় চান্দগাঁও ক্লিনার্স সার্ভিস।
নিজের ওয়ার্ডে বেশি বরাদ্দ
বিদায়ী মেয়রের আমলে আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওতায় বিমানবন্দর সড়কসহ বিভিন্ন সড়ক উন্নয়ন ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্প একনেক সভায় অনুমোদন পায়।
এই প্রকল্পের আওতায় সবচেয়ে বেশি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় ৬ নম্বর পূর্ব ষোলশহর ওয়ার্ডে। ২০টি লটের বিপরীতে ১২২ কোটি ১৯ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই টাকায় ৪৭টি সড়ক ও উপসড়ক সংস্কার ও উন্নয়ন করা হবে।
রেজাউল করিমের বাড়ি এই ওয়ার্ডে। অথচ আয়তন ও জনসংখ্যায় এই ওয়ার্ড অনেক পিছিয়ে। এই ওয়ার্ডের চেয়ে অন্য ২০টি ওয়ার্ডে বেশি জনসংখ্যা রয়েছে।
এসবের বাইরেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের টাকায় সাতটি দেশ সফর করেন রেজাউল করিম চৌধুরী। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের টাকায় গিয়েছেন ফিনল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান। আরও চারটি দেশে ব্যক্তিগত সফরে গিয়েছেন তিনি। দেশগুলো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব ও ভারত। ভারত সফরে মেয়রের সঙ্গে ছিলেন সিটি করপোরেশনের দুই ঠিকাদার।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় মেয়র ও চেয়ারম্যানদের একচ্ছত্র ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। অনিয়ম–দুর্নীতি করলেও মেয়রদের তেমন কোনো জবাবদিহি করতে হয় না। এ কারণে সেবার দিকে মনোযোগ না দিয়ে বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং সক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও লোক নিয়োগে বেশি ব্যস্ত থাকেন মেয়ররা। দেশের অন্যান্য সিটি করপোরেশনের মতো চট্টগ্রামের অপসারিত মেয়র অনিয়ম–দুর্নীতি করেছেন। এগুলোর তদন্ত হওয়া দরকার।