কক্সবাজার সৈকতে রাতেও কেন এত ভিড়, দেখেছেন এর মোহনীয় রূপ
অন্ধকার রাত, শুকনা বালুচরে গোল হয়ে বসে আড্ডা-আলোচনায় ব্যস্ত ১০-১২ জন পর্যটক। দলের সামনে, ডানে-বাঁয়ে হাজারো নারী-পুরুষের সমাগম। কেউ গোল হয়ে দাঁড়িয়ে কফিতে চুমুক দিচ্ছেন কিংবা ঝালমুড়ি খাচ্ছেন। মাথায় সাদা ফেনা নিয়ে কূলের দিকে ছুটে আসা ঢেউ গুনছেন কেউ। কেউবা সাগরে মধ্যে টিমটিমে আলো ছড়িয়ে ছুটে চলা মাছ ধরার ট্রলারের দিকে তাকিয়ে আছেন মুগ্ধ দৃষ্টিতে। এর মধ্যে থেকে থেকে ভেসে আসছে সমবেত গানের সুর।
গত মঙ্গলবার রাত ৯টায় কক্সবাজার সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত টানা সাড়ে তিন ঘণ্টা সৈকতের কলাতলী, সুগন্ধা, সিগাল, লাবণী পয়েন্টের পাঁচ কিলোমিটার ঘুরে এমন ভিড় দেখা গেল।
রাত ১১টায় সিগাল পয়েন্টের কিটকটে (আরাম চেয়ার) বসে আড্ডা জমান ২০-২৫ জন তরুণ-যুবক। রোববার রাতের বাসে তাঁরা কুমিল্লার চান্দিনা থেকে রওনা দেন, সোমবার দুপুরে কক্সবাজার পৌঁছান। দুপুরে এক দফা সৈকতে নামেন। দ্বিতীয় দফায় সৈকতে নামেন বিকেল পাঁচটায়। গানবাজনার পাশাপাশি সবাই হইচই আর আনন্দে মেতেছিলেন।
দলের একজন আবরার ফাহিম (২১) বলেন, ‘বিকেলে বালুচরে দাঁড়িয়ে সবার সূর্যাস্ত দেখা হয়েছে। এর আগে মেরিন ড্রাইভ দেখা হলো, যার একপাশে সমুদ্র, আরেক পাশে পাহাড়ের সারি। সবকিছু ছাপিয়ে রাতের অন্ধকার সৈকতের আনন্দ অন্য রকম মনে হচ্ছে। বলা যায়, দিনের চেয়েও রাতের সৈকত অনেক মজার। সমুদ্রের গর্জনের আর ঘন কুয়াশায় মোড়ানো শীতের হিমেল বাতাস মিলে ভীষণ অন্য রকম পরিবেশ।’
বালুচরে বাতি জ্বালিয়ে স্থানীয়ভাবে আনারকলি নামে পরিচিত প্যাশন ফল বিক্রি করছিলেন রোকসানা আক্তার (৩৫)। প্রতিটির দাম ৬০ টাকা। ছুরি দিয়ে ফল দ্বিখণ্ডিত করে তাতে লবণ-মরিচ মিশিয়ে পর্যটকের হাতে তুলে দেন। পর্যটকেরা প্যাশন ফল খেতে খেতে জেনে নেন ফলের বৃত্তান্ত। রোকসানা বলেন, আনারকলি পর্যটকদের কাছে অচেনা ফল। এই ফল কক্সবাজার অঞ্চলে জন্মে। গ্রাম থেকে প্রতিটি ফল ৪০ টাকায় কিনে এনে সৈকতে ৬০ টাকায় বিক্রি করেন। ভোররাত পর্যন্ত সৈকতে পর্যটকের সমাগম থাকে, আনারকলির বিক্রিও ভালো হয়। আগের রাতে তিনি ৪৫০টি আনারকলি বিক্রি করেছেন।
চেয়ার-ছাতার নিচে বসে থাকা পর্যটকদের কাছে ক্ষণে ক্ষণে ধরনা দেন চা, কফি ও শামুক-ঝিনুক দিয়ে তৈরি রকমারি পণ্যের বিক্রেতারা। তৎপর শতাধিক ভ্রাম্যমাণ আলোকচিত্রীও। অন্ধকার রাতে সমুদ্রকে পেছনে রেখে ডিজিটাল ক্যামেরার একটা ক্লিক সারা জীবনের স্মৃতি হয়ে থাকবে—এমন বাণীর সঙ্গে ওই ছবির গুণ ও মান কেমন হবে, তা পর্যটকদের বুঝিতে দেন আলোকচিত্রীরা। কথা শুনে পর্যটকদের অনেকে ছবি তুলতে রাজি হন। আলোকচিত্রী অন্ধকার রাতে ফ্ল্যাশ মেরে তুলে দেন ছবি, আয় করেন হাজার টাকা।
আলোকচিত্রী জালাল আহমদ (৩০) বলেন, দিনের বেলায় পর্যটকেরা নিজের মুঠোফোন দিয়ে ইচ্ছেমতো ছবি তোলেন। তখন আলোকচিত্রীর তেমন দরকার পড়ে না। বিচ বাইকে, ঘোড়ার পিঠে কিংবা সমুদ্রের পানিতে গোসলে নামলে তখন আলোকচিত্রীর ডাক পড়ে। কিন্তু রাতের সৈকতে মুঠোফোনে ছবি তোলা গেলেও তেমন ভালো হয় না। তাই অনেকে রাতের স্মৃতি ধরে রাখতে আলোকচিত্রীর সহযোগিতা নেন। প্রতি রাতে একজন আলোকচিত্রী এক হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত আয় হয়।
কিন্তু রাতের সৈকত কতটুকু নিরাপদ? এমন প্রশ্নের জবাবে ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, রাত-দিন চব্বিশ ঘণ্টাই কক্সবাজারের সৈকত নিরাপদ। এখন দুই লাখের বেশি পর্যটক অবস্থান করছেন। আগের তুলনায় নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। সৈকতের কলাতলী থেকে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটারে এখন দিন–রাত ২৪ ঘণ্টা পর্যটকে ভরপুর থাকছে। তাঁদের নিরাপত্তায় ট্যুরিস্ট পুলিশের সদস্যদেরও ২৪ ঘণ্টা ডিউটি দিতে হচ্ছে। এ পর্যন্ত কোনো অঘটন ঘটেনি।
অন্য রকম রাতের সৈকত
রাত সাড়ে ১১টায় সুগন্ধা পয়েন্টের কিটকটে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন ঢাকার রমনার রেস্তোরাঁমালিক গিয়াসুল আজিম। সঙ্গে স্ত্রী ও দুই ছেলে–মেয়ে। রাতের সৈকত দেখতে কেমন লাগে, জানতে চাইলে গিয়াসুল বলেন, ‘শহরে লোডশেডিং হলে বাসাবাড়িতে যেমন মিটমিট আলো জ্বলে, রাতের সৈকতের দৃশ্যটাও তেমন লাগছে। আলো-আঁধারির সমুদ্রসৈকতে শীতের রাত দারুণ উপভোগ্য। সৈকত ছেড়ে হোটেলে যেতে ইচ্ছা করছে না।’
সুগন্ধা সড়কের দুই পাশে বাতি জ্বালিয়ে ভাজা মাছ, পরোটা, কাবাব, ডিম আর চা বিক্রি হয় শতাধিক দোকানে। চার চাকার একটি ভ্যানগাড়িতে দেখা গেল কাঁচা সামুদ্রিক মাছ সাজিয়ে রাখা হয়েছে। দল বেঁধে পর্যটকেরা সেখানে যাচ্ছেন। এরপর পছন্দের মাছ কিনলে দোকানদার সঙ্গে সঙ্গে ভেজে দিচ্ছেন। চেয়ারে বসে কিংবা দাঁড়িয়ে গরম-গরম ভাজা মাছে চলে ভোজনবিলাস। সন্ধ্যা থেকে খাবারের দোকানগুলোয় ভিড় জমে থাকে, বেচাবিক্রি চলে ভোররাত পর্যন্ত।
একটি রেস্তোরাঁর মালিক আবুল হোসেন (৪৫) বলেন, রাত ১২টা পর্যন্ত বিক্রি বেশি হয়, রাত ১টার পর পর্যটকের সংখ্যা কমতে থাকে। তবে ভোররাতেও অনেকে ভাজা মাছ খেতে ছুটে আসেন। দোকানগুলোতে কোরাল, পোপা, মাইট্যা, লবস্টার, কাঁকড়া, চিংড়ি, রাঙাচকি, রুপচাঁদা, অক্টোপাসসহ নানা সামুদ্রিক মাছ রাখা হয়।
কক্সবাজার হোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, সুগন্ধা সড়কে ভ্যানগাড়িতে যেসব মাছ বিক্রি হয়, এর অধিকাংশই খাওয়ার অনুপযোগী। পচা মাছে হলুদ রং মিশিয়ে পর্যটকদের ভেজে খাওয়ানো হয়। পর্যটকদের অনেকের কাছে সামুদ্রিক মাছ অচেনা। ভাজা মাছ খেয়ে অনেকে অসুস্থ হচ্ছেন।
শহরের পাঁচ শতাধিক হোটেল, গেস্টহাউস, রিসোর্ট ও কটেজে এখন দুই লাখের মতো পর্যটক অবস্থান করছেন জানিয়ে আবুল কাশেম সিকদার বলেন, থাইল্যান্ডের পাতায়া কিংবা দুবাই, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ার মতো সমুদ্রকেন্দ্রিক বিনোদন বাড়ানো গেলে পর্যটকের সমাগম আরও বেড়ে যাবে।