সরাসরি গ্রাহকের কাছে বিক্রির জন্য বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হবে: বিদ্যুৎ উপদেষ্টা

‘জ্বালানির দ্রুত রূপান্তর: স্থানীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তব্য দিচ্ছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। আজ রাজধানীতে ইআরএফ মিলনায়তনেছবি: সংগৃহীত

বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তার পুরোটা সরকারের কাছে বিক্রির মডেল অনেক পুরোনো বলে মন্তব্য করেছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি বলেন, বেসরকারি খাতে নতুন করে ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হবে না। মার্চেন্ট বিদ্যুৎ নীতি করা হচ্ছে। এতে সরাসরি গ্রাহকের কাছে বিক্রির জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে।

ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত এক সেমিনারে এ কথা বলেছেন ফাওজুল কবির খান। ‘জ্বালানির দ্রুত রূপান্তর: স্থানীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা’ শীর্ষক এ সেমিনার আজ শনিবার রাজধানীতে ইআরএফ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিদ্যুৎ উপদেষ্টা আরও বলেন, হুইলিং চার্জ দিয়ে সরকারি সংস্থার বিতরণ লাইন ব্যবহার করতে পারবে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র।

প্রসঙ্গত, বর্তমানে দেশের সব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে চুক্তি অনুসারে নির্ধারিত দামে সব বিদ্যুৎ কিনে নেয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। বেশি দামে কিনলেও তারা সরকার নির্ধারিত দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করে বিতরণ সংস্থার কাছে। এতে প্রতিবছর পিডিবিকে লোকসান গুনতে হয়, যা ভর্তুকি হিসেবে দেয় সরকার।

বিদ্যুৎ উপদেষ্টা বলেন, বিদ্যুৎ খাতে বছরে ভর্তুকি ৩২ হাজার কোটি টাকা। জ্বালানিতে ভর্তুকি ২০ হাজার কোটি টাকা। এমন ভর্তুকিনির্ভর বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত চলবে না। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, গত আওয়ামী লীগ সরকার দুর্নীতি করার জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন করেছিল। এটি অসাংবিধানিক, তাই ইতিমধ্যে এটি বাতিল করা হয়েছে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কোনো বিকল্প নেই বলে জানান ফাওজুল কবির খান। তিনি বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরের বাধ্যবাধকতা আছে সরকারের। এর জন্য জমির কোনো সমস্যা নেই। সরকারি জমি অব্যবহৃত পড়ে আছে। রেলের জমি আছে, সড়কের জমি আছে। হাজার হাজার একর জমি ইকোনমিক জোনের নামে অধিগ্রহণ করা হয়েছে। সরকারি এসব জমি নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে ব্যবহার করা হবে।

আগের সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রসারের কথা বললেও আন্তরিকভাবে তা চায়নি বলে মন্তব্য করেন বিদ্যুৎ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, সরকার চাইলে এটি হতো। নবায়নযোগ্য জ্বালানির অর্থায়নে সব সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে। শুল্ক কমানোর পরিবর্তে উদ্যোক্তাদের আমদানি এড়িয়ে দেশে সৌর বিদ্যুৎ যন্ত্রপাতি উৎপাদনের পরামর্শ দেন তিনি।

দেশে জ্বালানির প্রাথমিক চাহিদা পূরণ করাই বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, দিনে গ্যাসের চাহিদা ৪০০ কোটি ঘনফুট। সরবরাহ করা হয় প্রায় ৩০০ কোটি ঘনফুট। ঘাটতি ১০০ কোটি ঘনফুট, যা দিন দিন আরও বাড়ছে। আমদানি বেশি বাড়ানো যাবে না। তাই কূপ খনন করে দেশে উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। জ্বালানির অভাবে হাজার হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র পড়ে আছে। বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের ব্যবহার কমাতে পারলে শিল্প খাতে সরবরাহ বাড়বে।

ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, সম্পদ দেখে নয়, ব্যালান্স শিট দেখে ঋণ দেওয়ায় বেশি উৎসাহী ব্যাংক। খেলাপি ঋণের বেশির ভাগই ব্যালান্স শিটনির্ভর, যা আসলে সবই ফাঁকা, শুধু কিছু সংখ্যানির্ভর। বেক্সিমকো এবং এস আলম ব্যালান্স শিট দেখিয়ে ঋণ নিয়েছে, এখন বেতন দিতে পারছে না। খেলাপি ঋণ এখন তিনি লাখ কোটি টাকা।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে অর্থায়ন এখনো শুরুর দিকে। ব্যাংকগুলো স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগে ঋণ দিতে উৎসাহী। তাই নবায়নযোগ্য জ্বালানির মতো দীর্ঘমেয়াদি খাতে ঋণের ঝুঁকি নিতে চায় না। ব্যাংকগুলোকে নতুন ধারার অর্থায়নে উৎসাহী করতে হবে। তবে বিদেশি বিনিয়োগ না এলে জ্বালানি রূপান্তরে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ‘গেম চেঞ্জার’ হবে না।

সিটি ব্যাংকের চিফ ইকোনমিস্ট ও কান্ট্রি বিজনেস ম্যানেজার মো. আশানুর রহমান বলেন, বিদ্যুৎ খাতে দেশি মোট বিনিয়োগের ১৫ শতাংশ সিটি ব্যাংকের। তাঁরা সম্প্রতি সৌর ও বায়ুচালিত দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিনিয়োগ করেছেন। উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ চাহিদা নিয়ে ব্যাংকে আসতে হবে। এ খাতের যন্ত্রপাতি আমদানিতে অতিরিক্ত শুল্কের কারণে বিনিয়োগ লাভজনক মনে করে না অনেকে।

ইআরএফ, সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড পার্টিসিপেটরি রিসার্চ (সিইপিআর), কোস্টাল লাইভলিহুড অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল অ্যাকশন নেটওয়ার্ক (ক্লিন) ও বিডব্লিউজিইডি যৌথভাবে এ সেমিনারের আয়োজন করেছে। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিইপিআরের চেয়ারপারসন গৌরাঙ্গ নন্দী। তিনি সহজে অর্থায়নের জন্য একটি বিশেষ তহবিল গঠনের প্রস্তাব করেন।

ইআরএফের সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মৃধার সভাপতিত্বে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন।