বিমানে এত স্বর্ণ কারা রেখেছিল, এত দিনেও জানা গেল না
বছর দুয়েক আগে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামে। ২০২১ সালের ৫ অক্টোবর বিকেল ৪টা ১৮ মিনিটে অবতরণ করা ওই ফ্লাইটের সব যাত্রী নেমে যাওয়ার পর তল্লাশি চালিয়ে উড়োজাহাজের শৌচাগারে পৃথক দুটি টিস্যুর ঝুড়ি থেকে ১২০টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করে শুল্ক গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ, যেগুলোর ওজন প্রায় ১৩ কেজি ৯২০ গ্রাম।
এ ঘটনায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মাহাবুর রহমান বিমানবন্দর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করেন। মামলাটি প্রথমে (পাঁচ দিন) তদন্ত করেছিল বিমানবন্দর থানা-পুলিশ। তবে কারা উড়োজাহাজের শৌচাগারে স্বর্ণ রেখেছিল, পুলিশ তাদের কাউকে খুঁজে বের করতে পারেনি।
অবশ্য পরবর্তী সময়ে মামলার তদন্তভার যায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি)। তবে তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার এত দিন পরও সিআইডি ওই স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িতদের কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি।
এ ব্যাপারে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব স্বর্ণ কারা ময়লার টিস্যুর ঝুড়িতে রেখেছিল, সেটি আমরা বের করতে পারিনি।’
অবশ্য মামলার বাদী মাহাবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘উড়োজাহাজের পাইলট, ক্রু, যাত্রীরা সবাই নেমে যাওয়ার পর বিমান ফ্লাইট ক্যাটারিং সেন্টারের কর্মচারী, টেকনিশিয়ান ছাড়া অন্য কেউ উড়োজাহাজের ভেতর প্রবেশ করতে পারে না। অর্থাৎ এই স্বর্ণ চোরাচালানে সংঘবদ্ধ একটি চক্র জড়িত রয়েছে।’
এই শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তা আরও জানান, মামলা দায়েরের পর তদন্তের বিষয়ে পুলিশের কোনো কর্মকর্তা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেননি।
কেবল এই ১৪ কেজি স্বর্ণ চোরাচালানের ঘটনাটিই নয়, দুই বছরের ব্যবধানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পৃথক চারটি ফ্লাইট থেকে সাড়ে ৩৫ কেজির বেশি স্বর্ণ উদ্ধার করে শুল্ক গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ। এসব চোরাচালানের ঘটনায় জড়িত কাউকেই শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। মামলার কাগজপত্রে এবং সংশ্লিষ্ট থানা ও তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে।
গত বছরের ২৪ এপ্রিল সকাল সাড়ে ১০টায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজাহ থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামে। পরে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা বিমানের কার্গো হোলের ভেতরে বিশেষভাবে লুকিয়ে রাখা ৮৮টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করে, যেগুলোর ওজন প্রায় ১০ কেজি ২৫২ গ্রাম।
এ ঘটনায় শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তা শেখ সাবিহা জামাল অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে বিমানবন্দর থানায় মামলা করেন। এই স্বর্ণ চোরাচালানের ঘটনায় জড়িত কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ।
যোগাযোগ করা হলে বিমানবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজিজুল হক মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, বিমানবন্দরে ক্লোজড সার্কিট (সিসি) টেলিভিশন ক্যামেরার আওতার বাইরে যখন স্বর্ণ চোরাচালানের অপরাধমূলক ঘটনা সংঘটিত হয়, তখন অপরাধীদের শনাক্ত করা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। এতে স্বর্ণ চোরাচালানের অনেক ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।
স্বর্ণ চোরাচালানের মামলার কাগজপত্রের তথ্য বলছে, গত বছরের ৩০ এপ্রিল দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিটে শারজাহ থেকে চট্টগ্রাম হয়ে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট। পরে বিমানের ভেতর ময়লার ঝুড়িতে ৭০টি স্বর্ণের বার পাওয়া যায়, যেগুলোর ওজন প্রায় ৮ কেজি ১২০ গ্রাম।
এ ঘটনায় কাস্টমস হাউসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আবদুর রহিম বাদী হয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের নামে বিমানবন্দর থানায় মামলা করেন। মামলার এক বছর পার হলেও পুলিশ কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বিমানবন্দর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) এনায়েত কবির প্রথম আলোকে বলেন, কারা এসব স্বর্ণ রেখেছিল, সেটি বের করা সম্ভব হয়নি। তিনি ওই বিমানের যাত্রী, ক্রুসহ অন্যদের তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছেন।
পুলিশের কর্মকর্তা ও শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা মনে করেন, উড়োজাহাজের ভেতর পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া স্বর্ণের বেশির ভাগই সংঘবদ্ধ চোরাচালান চক্রের।
১৪ কেজি স্বর্ণ উদ্ধারের ঘটনায় গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর লিখিতভাবে আদালতকে জানানো হয়, স্বর্ণ চোরাচালানের মূল হোতাদের ধরার জন্য বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের (ফ্লাইট নম্বর বিজে ৪০৪৮) সব যাত্রীর পাসপোর্ট বিবরণী, সিট নম্বর, লাগেজের বিবরণীসহ বিমান ক্রুদের নাম ও ঠিকানা জানার জন্য বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস বরাবর চিঠি দেওয়া হয়েছে।
সিআইডি কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ওই ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করার জন্য বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই করে জড়িতদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।
২০২১ সালের ৩০ এপ্রিল রাত দুইটার সময় সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ফ্লাইট (বিজে ৫০৪৬) হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামে। পরে শুল্ক গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ উড়োজাহাজের ভেতরে তল্লাশি চালিয়ে ১৮-জি নম্বর সিটের নিচে স্কচটেপ দিয়ে মোড়ানো দুটি বান্ডিল উদ্ধার করে। দুটি বান্ডিলে ২৮টি স্বর্ণের বার পাওয়া যায়, যেগুলোর ওজন প্রায় ৩ কেজি ২৪৮ গ্রাম।
এ ঘটনায় শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বদর উদ্দিন বাদী হয়ে মামলা করেন। এ ঘটনায় জড়িত কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ নুরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, বিমানের ভেতর পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া সোনা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করা তদন্ত সংস্থার দায়িত্ব। প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করার জন্য নিবিড়ভাবে তদন্ত করা জরুরি। বিমান বাংলাদেশ কিংবা অন্য কোনো সংস্থার কোনো পর্যায়ের কেউ জড়িত যদি থাকে, তাদের খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। মামলাগুলো তদন্ত করে যত দ্রুত সম্ভব অপরাধীদের শনাক্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া উচিত।