সিলেট বিভাগের বন্যায় আক্রান্ত এলাকার উজান আর ভাটি দুই জায়গাতেই দ্রুত বনভূমি উজাড় হচ্ছে। গভীর নদ-নদী অনেকখানিই ভরাট হয়ে গেছে। যে কারণে বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে পারছে না। প্রাকৃতিক পানির আধারগুলো ভরাট হয়ে সেখানে বসতি এলাকা ও শহর গড়ে উঠছে। ফলে বৃষ্টির পানি দ্রুত উজান থেকে নেমে এসে সিলেট শহর ভাসিয়ে দিচ্ছে।
সিলেট অঞ্চলের বন্যার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানে করা তিনটি গবেষণায় এই একই চিত্র পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহসভাপতি স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, সিলেট শহরে বন্যার কারণ ও ফলাফল নিয়ে তাঁরা দেড় মাস ধরে গবেষণা করছেন। তাতে প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে, শহরের নতুন আবাসিক এলাকার প্রায় ১৫ কিলোমিটার নদীতীরবর্তী এলাকায় জলাভূমি ভরাট করে গড়ে উঠেছে। আর হাওরের পানি নামার জায়গাগুলো সংকুচিত হচ্ছে। যে কারণে বন্যার পানি সিলেট-সুনামগঞ্জ ছাড়িয়ে আরও বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। আর কিশোরগঞ্জে হাওরের মাঝবরাবর তৈরি করা প্রায় ৩০ কিলোমিটার সড়কের (অলওয়েদার রোড) কারণে পানি নামতে পারছে না। বন্যার সময়কাল দীর্ঘ হচ্ছে।
গবেষণাগুলোতে বলা হয়েছে, একসময় ভারী বৃষ্টিতে সেখানে দুই থেকে চার দিন হঠাৎ বন্যা হতো। গত এক যুগে তা বেড়ে ৭ থেকে ১২ দিন পর্যন্ত থাকছে। ফলে উত্তরাঞ্চলের পর সিলেট বিভাগ হয়ে উঠেছে দেশের মৌসুমি বন্যার অন্যতম এলাকা।
চলতি বছরের মার্চে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়জন গবেষক মিলে ‘ভূমির ব্যবহারের ধরনে বদল, হঠাৎ বন্যার ধরনে কী ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসছে: সিলেটের অঞ্চলের ওপর একটি পর্যালোচনা’ শীর্ষক একটি গবেষণা করেছেন। ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৯১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে সিলেটের উজানে ভারতের মেঘালয়ের বনভূমির ১৮ শতাংশ কমে গেছে। পাহাড়ি ওই এলাকার বনভূমি কেটে সেখানে কৃষিকাজ শুরু হয়েছে। বসতি ও শহরও গড়ে উঠছে।
গবেষণাটিতে বলা হয়েছে, মেঘালয়ের ভাটির এলাকা সিলেটে ২০০২ সালে পৌনে ৩ শতাংশ এলাকা ছিল বসতি ও কৃষিজমি। ২০২২ সালে তা ৩৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ হয়েছে। ওই সময়ের মধ্যে বসতি এলাকা বেড়ে ১০ দশমিক ৬৩ শতাংশ হয়েছে। আর বনভূমি কমেছে ২৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ। ফলে উজানে ভারী বৃষ্টি শুরু হলে তা দ্রুত ভাটিতে নেমে আসছে। অর্থাৎ পানি ধরে রাখত যে বনভূমি ও নদী, তা ধ্বংস হওয়ায় বন্যার পানি দ্রুত সিলেটকে ভাসিয়ে দিচ্ছে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে খুলনায় অনুষ্ঠিত ‘সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তা তুলে ধরা হয়। গবেষণাটিতে দেখা গেছে, ২০০২ সালে মেঘালয়ে বৃষ্টি শুরু হওয়ার ১২ ঘণ্টার মাথায় সিলেটে হঠাৎ বন্য শুরু হতো। আর ২০২২ সালে বৃষ্টি শুরু হওয়ার ৭ ঘণ্টার মাথায় বন্যা শুরু হয়েছে।
গবেষণাটিতে বলা হয়েছে, ২০০০ সালের তুলনায় বর্তমানে জনসংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। আর সড়ক বেড়েছে ৫১ দশমিক ৬৮ শতাংশ। বনভূমি আছে এমন এলাকা দিয়ে বন্যার পানি নামতে বেশি সময় নেয়। বিশেষ করে মাটি ও ঘাসসমৃদ্ধ এলাকাগুলো পানি ধরে রাখে ও ভূগর্ভে চলে যায়। আর যেসব এলাকায় শহর ও পাকা বসতি হয়েছে, সেখানে পানি দ্রুত নেমে যায়। ভূগর্ভে পানি সহজে নামতে পারে না।
যুক্তরাষ্ট্রের লক হেভেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. খলীকুজ্জামান কয়েক যুগ ধরে বাংলাদেশের হাওর এলাকা নিয়ে গবেষণা করছেন। তাঁর এক গবেষণায় দেখা গেছে, মেঘালয় ও সিলেটে ১৯৫৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বৃষ্টির ধরন পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। সাধারণত আগে ওই এলাকায় এপ্রিল ও মে মাসে বৃষ্টি হতো। গত কয়েক যুগের ব্যবধানে সময় পাল্টে বৃষ্টিপাত হচ্ছে জুনের দিকে। ওই সময় উজান থেকে নেমে আসা পানি শিগগিরই নামতে পারে না। কারণ, বর্ষার এই সময়টায় দেশের অন্য নদ-নদীগুলো এমনিতেই পানিতে ভরা থাকে।
গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, হাওর এলাকার ঘোড়াউত্রা ও মেঘনা নদী অববাহিকার পানি নিষ্কাশনব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। মেঘনা নদীর ভৈরব সেতুর এক পাশে নদীটি চওড়ায় ১ হাজার ৭৫৬ মিটার। আর সেতুর অপর পাশে অর্থাৎ ভাটির দিকে যেখান দিয়ে পানি নিষ্কাশিত হয়, সেখানে নদীটির প্রশস্ত কমে ৬৭১ মিটারে এসে ঠেকেছে। মাত্র ৭৮৫ মিটার দূরত্বে নদীটির বিপুল অংশ সংকুচিত হয়ে যাওয়ায় পানিনিষ্কাশন ব্যাহত হচ্ছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, সিলেট ও উজানে ভারী বৃষ্টি কমে আসছে। তবে আগামী কয়েক দিন বৃষ্টির পরিমাণ কমে আসতে পারে। এতে বন্যার পানি নামতে শুরু করবে।