শাপলা চত্বরে গণহত্যা
শেখ হাসিনাসহ ৪৪ জনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কাছে অভিযোগ
রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে ১১ বছর আগে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশকে কেন্দ্র করে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৪ জনের নাম উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর বরাবর আবেদন করা হয়েছে। আজ রোববার দুপুরে অভিযোগটি দাখিল করা হয়।
শাপলা চত্বরে হেফাজতের ওপর চালানো ‘গণহত্যায়’ নিহত বুয়েটের তৎকালীন শিক্ষার্থী রেহান আহসানের মা ইফফাত আরা অভিযোগটি করেছেন বলে জানান তাঁর আইনজীবী এস এম তাসমিরুল ইসলাম।
ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে তাসমিরুল সাংবাদিকদের বলেন, ‘২০১৩ সালের ৫ মে রাত সাড়ে আটটা থেকে সাড়ে নয়টার মধ্যে রেহানকে শাপলা চত্বরসংলগ্ন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব গলিতে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে তাঁর লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাওয়া যায়। ময়নাতদন্ত করা হলেও রিপোর্ট রেহানের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। তৎকালীন থানা ও স্থানীয় প্রশাসনসহ আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের চাপে তাঁর পরিবার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ এত দিন সামনে আনতে পারেনি। ছাত্র–জনতার গণ–অভ্যুত্থানের পরে রেহানের পরিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাছে বিচার চাইতে এসেছেন।’
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর তৎকালীন প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর এবং প্রতিমন্ত্রী, আওয়ামী লীগ ও তাদের জোটের নীতিনির্ধারক ফোরামে যারা ছিল এবং ৫ মে পরিচালিত যৌথ অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া তৎকালীন পুলিশের আইজিপি, র্যাবের মহাপরিচালক, ডিএমপি কমিশনারসহ ৪৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে বলে জানান এই আইনজীবী। পাশাপাশি অজ্ঞাতনামাদেরও আসামি করা হয়েছে।
আইনজীবী তাসমিরুল ইসলাম আরও বলেন, মূলত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অভিযোগ। হেফাজতে ইসলাম অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠন। তাদের ১৩ দফা দাবি ছিল, যা সম্পূর্ণ ধর্মীয় দাবি। আইনি বিধান অনুযায়ী ধর্মীয় একটি দলকে ধ্বংস করে দেওয়া বা পুরোপুরি নির্মূল করে দেওয়ার জন্য বিস্তৃত ও পদ্ধতিগতভাবে যে অভিযান চালানো হয়েছিল, তার মধ্যে রেহান একজন। রেহান হেফাজত কর্মী ছিলেন না। হেফাজত ঘোষিত যে কর্মসূচি ছিল, তার সঙ্গে সমর্থন জানিয়ে তিনি সেখান উপস্থিত হয়েছিলেন।
আমি মুখ খুলতে পারিনি: রেহানের মা
অভিযোগ দাখিল করার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন রেহানের মা ইফফাত আরা। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মেয়ে ফারিয়া স্মরণী।
দীর্ঘদিন হয়ে গেল, ছেলের বিচার পেলেন না—এমন প্রশ্নে ইফফাত আরা বলেন, ‘আমি মুখ খুলতে পারিনি।’
আগে কখনো থানায় বা আদালতে মামলা করতে গিয়েছিলেন কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘না। সাহস পাইনি তখন। যাইনি, কারণ আমার ছেলের লাশটা কোনোরকম নওগাঁ পর্যন্ত পৌঁছে, আমাকে চাপ দেওয়া হয়েছিল তাড়াতাড়ি দাফন করে দিতে হবে।’
কারা চাপ দিয়েছিল—এমন প্রশ্নে রেহানের মা বলেন, ‘প্রশাসন থেকে। ছেলেকে দাফন করে ফিরে আসার পর আমাকে থানা থেকে ফোন করে জেরা করা হয়, ছেলে কোনো রাজনৈতিক আদর্শের ছিল কি না? আমার ছেলে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ছিল না। মূলত একজন ধর্মভীরু মুসলমান ছিল। বয়সের সাথে সাথে পরিপক্ব হতে চলছিল।’
রেহানের বয়স তখন ২৩ বছর ছিল এবং সে বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন বলে জানান ইফফাত আরা। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। তিনি বলেন, ‘৬ মে (২০১৩ সালের) সকালে মর্গে গিয়ে ছেলের লাশ পাই।…নিথর সেই দেহটা পড়ে ছিল। খুব সংকীর্ণ একটা স্ট্রেচারে, আমার ছেলে খুব লম্বা–চওড়া ও স্বাস্থ্য ভালো ছিল। স্ট্রেচারে তার জায়গা হচ্ছিল না। ওর বাবা শোক সামাল দিতে পারেনি। পরের বছর ওর বাবা মারা যায়।’
ইফফাত আরা বলেন, ‘আমি আমার দুটি মেয়েকে নিয়ে শোক ধারণ করে চলছি, দিনের পর দিন। অনেক কষ্টকর দিন আমরা পার করছি এখন পর্যন্ত।...ঘরে শূন্যতা, সব জায়গায় শূন্যতা, রেহানকে খুঁজে পাই না…কোনো জায়গায় পাই না।…এই ১১টা বছর আমি আসলেই আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম, যে হয়তো আর কখনোই দাঁড়াতে পারব না। ৫ আগস্টের পর ছাত্র–জনতার আন্দোলনে আমরা যে একটা বাক্স্বাধীনতা পেলাম, সেই সাহসে সাহসী হয়ে রেহানের হত্যার বিরুদ্ধে মামলা করার সাহস পেয়েছি।’
ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে সবার সহায়তা চেয়েছেন এই মাম। তিনি বলেন, ‘একটা শিক্ষিত ছেলে, মেধাবী একটা ছেলে সে তার অধিকারের কথা, সে তার মুখের কথা বলতে পারবে না? আজ এখানে আমি বলতে পারছি। কিন্তু এটা আমি কখনো বলতে পারি নাই। আমার ছেলে যে হেফাজতের আন্দোলনে মারা গেছে, এই হেফাজতের আন্দোলনের কথাটা আমি বলতে পারি নাই। একটা অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে, কী অ্যাকসিডেন্ট—প্রশ্নবোধক চিহ্ন। বলতে পারি নাই, একটা বাধা।’