মশা মারতে পারি না, হাসপাতালে শয্যা দিতে পারি না, কবরের খোঁজ দিতে পারি অ্যাপে
ডেঙ্গুর কারণে প্রতিদিন অন্তত ১০টি করে নতুন কবর খুঁড়তে হচ্ছে। মহামারি করোনার পর এখন কবরের চাহিদা তুঙ্গে।
কঠিন এ সময়ে সহজ সমাধান নিয়ে এল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। গত শুক্রবার উত্তর সিটি কবর ব্যবস্থাপনার ‘স্মার্ট’ ব্যবস্থা উদ্বোধন করে। এ ব্যবস্থায় একজন মানুষ তাঁর স্বজনকে কবর দেওয়ার জন্য কোথায় খালি জায়গা আছে, সেটা সহজে জানতে পারবেন।
‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ হতে হলে সবকিছুই স্মার্ট হতে হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মশা নিয়ন্ত্রণে স্মার্ট কোনো পরিকল্পনা না থাকা, চিকিৎসায় স্মার্ট কোনো ব্যবস্থা না থাকার মধ্যে কবরের খোঁজ ‘স্মার্টলি’ দেওয়াটা উদ্বেগজনক।
উদ্বেগটি এ কারণে নয় যে উত্তর সিটি কবর ব্যবস্থাপনার স্মার্ট ব্যবস্থা চালু করেছে, উদ্বেগ এ কারণে যে মশা নিয়ন্ত্রণে নেই, প্রতিদিন মানুষ মরছে, নগরবাসী নিজেকে নিয়ে, প্রবীণ স্বজনদের নিয়ে, শিশুসন্তানদের নিয়ে আতঙ্কে রয়েছে। উদ্বেগ এ কারণে যে সন্তান ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে সেরা মানের চিকিৎসা পাওয়াটা সহজ নয়।
দেশের সবচেয়ে ‘বড়’ হাসপাতাল ঢাকা মেডিকেল কলেজে ছোট্ট শিশুদের জন্য একটা বিছানার ব্যবস্থাও আমরা করতে পারি না।
এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মধ্যে কবরের খোঁজ দিতে ঘটা করে অ্যাপ উদ্বোধন সংবেদনশীলতার একটু ঘাটতি বলেই মনে হয়েছে।
মন্ত্রীর বক্তব্য ও অন্য দেশের ডেঙ্গু
মশা নিয়ন্ত্রণে কোনো ধরনের ব্যর্থতা মানতে নারাজ স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম। বিডিনিউজটুয়েন্টিফোরডটকমে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, মন্ত্রী ১০ আগস্ট সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘আমরা যদি সচেতন না করতে পারতাম, তাহলে আজকে হয়তো ৫-১০ লাখ ঢাকা শহরে আক্রান্ত হয়ে যেত।’
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, সিঙ্গাপুর তো অনেক বেশি পরিপক্ব। তারপরও ৫০ লাখ লোকের দেশে ৫ হাজার ২২১ জন আক্রান্ত হয়েছে।
পরিসংখ্যানের একটি সুবিধা হলো, সেটাকে নিজেদের মতো করে ব্যবহার করা যায়। যেমন মন্ত্রী তাজুল ইসলাম সিঙ্গাপুরে আক্রান্তের হিসাব দিলেও মৃত্যুর হিসাবটি দেননি। নিজের দেশে যেখানে দৈনিক ১০ জনের বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে, এ বছর মৃত্যুর সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে, সেখানে সিঙ্গাপুর ২০২৩ সালের ২৫ জুলাই পর্যন্ত মৃত্যু দেখেছে মাত্র দুজনের (দ্য স্টেইট টাইমসের খবর)।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কেন চিকিৎসক কম, নার্স কম, কেন সেখানে যথেষ্টসংখ্যক চিকিৎসক পাঠানো হচ্ছে না, সেই প্রশ্নই বড়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ডেঙ্গু পরিস্থিতির প্রতিবেদন ধরে অন্য দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। স্বৈরতান্ত্রিক দেশ কম্বোডিয়ায় ২০২৩ সালে (২৮তম রোগ তাত্ত্বিক সপ্তাহ পর্যন্ত) ৯ হাজার ৭৪ জন আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ২২ জন। মৃত্যুহার শূন্য দশমিক ২৩ শতাংশ, বাংলাদেশে যা দ্বিগুণের বেশি, শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ।
লাও প্রজাতন্ত্রে দুই হাজারের কিছু বেশি মানুষের ডেঙ্গু হয়েছে। কারও মৃত্যু হয়নি। বছরের ২৫তম রোগ তাত্ত্বিক সপ্তাহ পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় প্রায় ৫৭ হাজার মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ৩৯ জন।
ফিলিপাইনে গত ১০ জুন পর্যন্ত ৬৮ হাজারের মতো মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ২৩৪ জন। মৃত্যুহার বাংলাদেশের চেয়ে কম (শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ)। ভিয়েতনামে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৫১ হাজারের বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ১১ জন।
ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল (ইসিডিসি) গত ৩১ জুলাই এক ম্যাপ প্রকাশ করে, যেখানে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের চিত্র তুলে ধরা হয়। সেটায় দেখা যায়, ডেঙ্গু আক্রান্তের দিক দিয়ে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় থাকা দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সারিতে রয়েছে বাংলাদেশ।
ইসিডিসির প্রতিবেদন বলছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত বেশি আর্জেন্টিনায়। সেখানে চলতি বছরের প্রথম ২৩ সপ্তাহে (সাড়ে ৫ মাস) প্রায় ১ লাখ ১১ হাজার মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন মাত্র ৬০ জন। বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম।
বাংলাদেশে ডেঙ্গুর যে পরিসংখ্যান দেওয়া হয়, তা পুরো চিত্র নয়। কারণ, সব হাসপাতালের তথ্য এতে থাকে না। তাই আমরা জানতে পারছি না আসলে কত আক্রান্ত হচ্ছে, কত মারা যাচ্ছে। যেমন ঢাকার হিসাব দেওয়া হয় ৭৭টি হাসপাতালের। এর বাইরে ৫০০টির বেশি হাসপাতাল রয়েছে। সেখানে রোগীরা যাচ্ছে, মৃত্যুও হচ্ছে।
বাংলাদেশে চলতি বছর ১১ আগস্ট পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মোট ৩৭৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। ডেঙ্গুতে মোট আক্রান্তের (হাসপাতালে ভর্তি) সংখ্যা ৮০ হাজার ৭৪।
দৈনিক বণিক বার্তা গত ১৩ জুলাই এক প্রতিবেদনে বিশ্লেষণ করে দেখায়, বিশ্বে ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে প্রতি ১ হাজার আক্রান্তের মধ্যে ৫ জনের বেশি মানুষ মারা যাচ্ছেন। এরপর রয়েছে পেরু, ১ দশমিক ৪৫ জন। বাকিগুলোতে মৃত্যু প্রতি হাজারে একজনের কম।
সব মিলিয়ে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে বাংলাদেশের মানুষ যথোপযুক্ত চিকিৎসা পাচ্ছে না। এ জন্য অবশ্য মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দিনরাত দায়িত্ব পালন করা চিকিৎসক ও নার্সদের দায়ী করা যায় না। হাসপাতালটিতে কেন চিকিৎসক কম, নার্স কম, কেন সেখানে যথেষ্টসংখ্যক চিকিৎসক পাঠানো হচ্ছে না, সেই প্রশ্নই বড়।
কেন জেলা হাসপাতাল থেকে রোগীদের ঢাকায় পাঠিয়ে দিতে হয়, কেন সেখানে ডেঙ্গুর চিকিৎসার সব ব্যবস্থা থাকবে না, সেটাও প্রশ্ন।
অবশ্য শিক্ষা, চিকিৎসায় যথেষ্ট ব্যয় না করে, ব্যবস্থাপনা যথেষ্ট উন্নত না করে জেলা হাসপাতালে সেরা সেবা পাওয়ার আশা করা যায় না। সেতু, রাস্তাঘাট, প্রয়োজনের বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের মতো আমরা যথেষ্ট হাসপাতাল নির্মাণ করেছি কি না, সেখানে চিকিৎসা সরঞ্জাম দিচ্ছি কি না, সেগুলোর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করছি কি না, সেই প্রশ্নও তোলা দরকার।
মশা মারতে অকেজো কামান
স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হতে পারত, সেটা তুলে ধরেছেন। কিন্তু হাজার হাজার মানুষ কেন আক্রান্ত হলো, সেটার ব্যাখ্যা তুলে ধরেননি।
ব্যাখ্যাটি এমন হতে পারত যে আমরা মশা মারতে পারিনি। সে কারণেই ডেঙ্গু অতীতের চেয়ে ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। মন্ত্রী তো আর এভাবে বলবেন না। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপেই উঠে এসেছে, ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে ডেঙ্গু মশার লার্ভা (শূককীট) পাওয়া বাড়ির সংখ্যা গত বছরের চেয়ে বেশি ও তা উদ্বেগজনক।
বিশ্বে ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে প্রতি ১ হাজার আক্রান্তের মধ্যে ৫ জনের বেশি মানুষ মারা যাচ্ছেন। এরপর রয়েছে পেরু, ১ দশমিক ৪৫ জন। বাকিগুলোতে মৃত্যু প্রতি হাজারে একজনের কম।
মশা মারতে আমরা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলামের দৌড়ঝাঁপ দেখছি। অন্যদের ক্ষেত্রে সেটা তেমন দেখা যায় না। কিন্তু এই দৌড়ঝাঁপে যে তেমন সফলতা আসছে না, সেটা বোঝা যায়। কারণ, এডিস মশা মারতে যে বৈজ্ঞানিক গবেষণাভিত্তিক কৌশল দরকার, সেটা নেই। তাই মেয়ররা একসময় গাপ্পি মাছ আনেন, আরেক সময় আনেন ব্যাকটেরিয়া (বিটিআই)।
গবেষণাটি করা উচিত ছিল স্বাস্থ্য বিভাগের। সেখান থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য বিভাগ, সিটি করপোরেশন, গবেষক ও নাগরিকদের যৌথ উদ্যোগে ডেঙ্গু নির্মূলে সমন্বিত অভিযান দরকার ছিল।
কবরের খোঁজ পাওয়ার অ্যাপের মতো আমাদের একটি অ্যাপ দরকার, যেটায় কোন হাসপাতালে রোগীর শয্যা খালি আছে, সেই তথ্য পাওয়া যাবে। ওই অ্যাপেই হাসপাতালে কোনো রোগী ভর্তি হলে তাঁর বাসার ঠিকানা পৌঁছে যাবে মশককর্মীদের কাছে। মশককর্মীরা তাঁর বাড়ির আশপাশের মশার খোঁজ করে নির্মূল করবেন কার্যকর ওষুধ দিয়ে।
তার বদলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, সরকারি এক হাসপাতালে মেঝেতেও রোগীর ঠাঁই হচ্ছে না, অন্য হাসপাতালে শয্যা খালি। ঢাকাজুড়ে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
এই নগরে আতঙ্কের জীবন
ঢাকায় নাগরিক জীবন দুঃসহ হয়ে উঠেছে। শীতে বায়ুদূষণ, বর্ষায় ডেঙ্গু, সারা বছর শব্দদূষণ।
যাঁদের শিশুসন্তান আছে, তাঁরা আতঙ্কে থাকেন ডেঙ্গুর। একটি মশা একটি পরিবারের জীবনে কী বেদনা নিয়ে আসতে পারে, তা পরিবারগুলো ছাড়া কেউ জানে না। একটি পরিবারকে জানি, যাদের একমাত্র সন্তান দুই বছর আগে ডেঙ্গুতে মারা গেছেন। বাকি জীবন হয়তো তাঁদের নিঃসঙ্গ কাটাতে হবে।
ডেঙ্গুতে গত সপ্তাহে মারা যাওয়া চিকিৎসক দেওয়ান আলমিনার স্বামী চক্ষুবিশেষজ্ঞ সোয়েব আহমেদ প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘এক মশার কামড়ে আমার পুরো পরিবার তছনছ হয়ে গেল। বাচ্চাগুলো (দুই মেয়ে) মা-হারা হলো। ওদের যে বয়স, বড় হতে হতে মায়ের স্মৃতি বলে আর কিছুই থাকবে না।’
সবশেষে একটাই প্রশ্ন, আমাদের এখন কী দরকার, ডেঙ্গু নির্মূল ও চিকিৎসায় ‘স্মার্ট’ ব্যবস্থাপনা, নাকি কবরের খোঁজের ‘স্মার্ট’ অ্যাপ।