গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিশন
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গুমের ঘটনা তদন্তে হাইকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে কমিশন গঠন করেছে সরকার।
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের ওই কমিশন গঠন করে গতকাল মঙ্গলবার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। কমিশনকে তদন্ত করে ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বিশেষ শাখা, গোয়েন্দা শাখা, আনসার ব্যাটালিয়ন, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), প্রতিরক্ষা বাহিনী, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই), কোস্টগার্ডসহ দেশের আইন প্রয়োগ ও বলবৎকারী কোনো সংস্থার কোনো সদস্যের হাতে জোর করে গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানের জন্য এই তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে।
কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত বিচারপতি মো. ফরিদ আহমেদ শিবলী, মানবাধিকারকর্মী নূর খান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাবিলা ইদ্রিস এবং মানবাধিকারকর্মী সাজ্জাদ হোসেন।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নেওয়ার পর লাশ উদ্ধার বা নিখোঁজের ঘটনাগুলো আলোচনায় ছিল। এ সময় হেফাজতে নিয়ে নির্যাতন, গোপন বন্দিশালায় দীর্ঘদিন আটকে রাখার ঘটনাগুলোও বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। পরদিন ৬ আগস্ট প্রায় আট বছর পর গোপন বন্দিশালা থেকে মুক্ত হন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (বরখাস্ত) আবদুল্লাহিল আমান আযমী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আহমাদ বিন কাসেম (আরমান)। একই দিনে পাঁচ বছরের বেশি সময় পর গোপন বন্দিশালা থেকে মুক্ত হন পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) নেতা মাইকেল চাকমা।
শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এই সরকারও গুমের ঘটনার তদন্তের কমিশন গঠনের কথা বলে আসছে। গুমের ঘটনায় তদন্তের দাবি জানিয়ে আসছে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন মায়ের ডাকও। সংগঠনটি ১৮ আগস্ট বিভিন্ন সময় গুমের শিকার ১৫৮ ব্যক্তির একটি তালিকা প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) মহাপরিচালকের কাছে দিয়েছে। এর আগে ২০২১ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে গুমের শিকার ৭৬ জনের একটি তালিকা বাংলাদেশ সরকারকে দিয়েছিল।
গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনেরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানালেও এই মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে ন্যায়বিচার পাননি। এই পরিস্থিতিতে গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে যুক্ত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ৩০ আগস্ট গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবসের আগেই এই সনদে যুক্ত হতে চায় বাংলাদেশ সরকার।
গত সোমবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন, অপহরণ এবং ‘আয়নাঘরের’ মতো চরম ঘৃণ্য অপকর্মের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে।
এরই মধ্যে গতকাল গুমের ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠন করে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করল। কমিশনের কার্যপরিধিতে ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান, তাঁদের শনাক্ত এবং কোন পরিস্থিতিতে গুম হয়েছেন, তা নির্ধারণের ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, জোরপূর্বক গুম হওয়ার ঘটনাগুলোর বিবরণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়া এবং এ বিষয়ে সুপারিশ করবে এ কমিশন। এ ছাড়া গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান পাওয়া গেলে তাদের আত্মীয়স্বজনকে জানানো এবং গুম হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে অন্য কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান তদন্ত করলে সেগুলোর তথ্য সংগ্রহ করবে এই কমিশন।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কমিশনকে সাচিবিক সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি কমিশনের প্রয়োজনীয় ব্যয় বহন করবে। কমিশনকে সহায়তা দিতে প্রজাতন্ত্রের যেকোনো ব্যক্তিকে দায়িত্ব দিতে পারবে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বলছে, কমিশনের সভাপতি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারক এবং সদস্যরা হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকের মর্যাদা এবং অন্যান্য সুবিধা ভোগ করবেন।
এদিকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আরেকটি প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহতের ঘটনায় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার তিন সদস্যবিশিষ্ট যে তদন্ত কমিশন গঠন করেছিল, তা বাতিল করা হয়েছে।