জাতিসংঘ থেকে চমকপ্রদ চিঠি

প্রিয় পাঠক, আমরা নিয়মিত আপনার লেখা ছাপাতে চাই। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনে ঘটা বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। দেশে থাকুন কি বিদেশে—নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]

১৯৮৮ সালের মাঝামাঝি কোনো একটা সময় হবে। তখন আমি পিরোজপুরের পাড়েরহাট রাজলক্ষ্মী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র। সে সময় অসম্ভব এক বন্যা হলো। মৌসুমি বৃষ্টি আর উজানের পানির ঢলে দেশের অর্ধেকের বেশি স্থলভাগ পানিতে থই থই। খবরের কাগজ ভরে উঠত বানভাসি মানুষের দুঃখ-দুর্দশার খবর আর ছবিতে।

আমাদের বাসায় টেলিভিশন ছিল না। আমার এক খালার বাসায় গিয়ে কিছু অনুষ্ঠান দেখার অনুমতি ছিল। সেই নির্ধারিত মাপা সময়টুকুতে সাপ্তাহিক নাটক, ধারাবাহিক নাটক আর ছায়াছন্দ দেখতাম। অল্প বয়সে সেসবের আকর্ষণ ছিল অসামান্য। সেসবের ভেতরে রাত আটটার খবর হতো।

সে খবরও দেখতাম। খবরে দেখতাম মাঠ, ঘাট, হাট, বাড়ি, ঘর—সব পানিতে ডুবে একাকার। আর তাতে বানভাসি মানুষের দুরবস্থা। তাদের আয়-রোজগারের একমাত্র সম্বল গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি কোনোরকমে আগলে নিয়ে একত্রে রাস্তা, বাঁধ বা বাড়ির ছাদে অবস্থান নিয়েছে। সামান্য খাবারের আশায় ক্ষুধার্ত নারী, পুরুষ, শিশু লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

তখন তো আমি স্কুলেরই ছাত্র। পড়াশোনার পাশাপাশি সেই বয়সে বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, ডয়চে ভেলে, এনএইচকে, ভেরিতাস, রেডিও তেহরান, রেডিও বেইজিং, ইউএন রেডিও ইত্যাদিতে আমার নিয়মিত চিঠি লেখার অভ্যাস ছিল। সেসব রেডিওর বাংলা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে খবর প্রচার করা হতো। তাদের প্রচারিত খবর আমার কিশোর মনকে ভীষণ নাড়া দিত।

সেই আবেগে উদ্বুদ্ধ হয়ে একদিন আমার মনে হলো, কিছু একটা করা দরকার। আমি বসে গেলাম কাগজ-কলম নিয়ে। ইংরেজিতে লিখে ফেললাম একটি চিঠি। যার-তার কাছে নয়, ড. হ্যাভিয়ের পেরেজ দ্য কুয়েলারের কাছে। তিনি তখন জাতিসংঘের মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। চিঠি লিখে হ্যাভিয়ের পেরেজ দ্য কুয়েলারকে আমি অনুরোধ করলাম, তিনি যেন বাংলাদেশের বন্যাকবলিত অসহায় মানুষের পাশে বিশ্বের ধনী দেশগুলোকে দাঁড়ানোর জন্য আহ্বান জানান।

চিঠিটি আমি ইউএন রেডিওতে পাঠিয়ে দিই, তারা যেন সেটি পাঠিয়ে দিতে পারে মহাসচিবের কাছে।

চিঠিটা পাঠানোর পর আব্বাকে ব্যাপারটা জানালাম। আব্বা বললেন, পোস্ট করার আগে অবশ্যই তাঁকে চিঠিটা দেখানো উচিত ছিল। বিশ্বের এত বড় সম্মানিত একজন লোকের কাছে লেখা চিঠি বলে কথা। কোনো ভুলচুক হলে কী ভীষণ লজ্জার ব্যাপার হবে! কিন্তু এখন কী আর করা। চিঠি তো পাঠানো হয়েই গেছে।

দেখতে দেখতে সময় চলে গেল। সেই চিঠির কথা মন থেকে কবে বেমালুম মুছেও গেছে।

 ১৯৮৯ সালের জানুয়ারি মাস। সামনে এসএসসি পরীক্ষা। জীবনের প্রথম সেই মস্ত বড় পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে অসম্ভব তোড়জোড় চলছে। সেই মহাব্যস্ততার দিনে একদিন ডাকপিয়ন এসে একটা চিঠি দিয়ে গেল। চিঠি হাতে নিয়ে আমি তো হতবাক। জাতিসংঘের পরিচ্ছন্ন খামে ভরা একটা চিঠি। খুব উৎসাহ নিয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে খামটা খুললাম।

ভেতরের চিঠিটা দেখে কিশোর আমি তো একেবারে বাক্‌রুদ্ধ। দেখতে পেলাম, জাতিসংঘের মহাসচিব হ্যাভিয়ের পেরেজ দ্য কুয়েলারের পক্ষ থেকে আমাকে চিঠির উত্তর দেওয়া হয়েছে। আমার চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার করে তাঁর পক্ষে জবাবি চিঠিটি লিখেছেন ড. ফিলিপ নামে ইউনাইটেড নেশনস ডিজাস্টার রিলিফ অরগানাইজেশনের (ইউএনডিআরও) পরিচালক।

আমাকে তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশের বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তাঁরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন। ইউএনডিআরওর একজন সমন্বয়কারী এরই মধ্যে বানভাসি মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিজের চোখে দেখার জন্য বাংলাদেশ সফর করে গেছেন।

আমি জানি, তাঁরা যেসব উদ্যোগ নিয়েছেন, তার পেছনে আমার চিঠির ন্যূনতম ভূমিকাও থাকার কোনো কথা নয়। তবু তাঁরা যে এইটুকু এক কিশোরের আবেগকেও এতটা মূল্য দিলেন, তাতে সেদিন মনটা ভরে গিয়েছিল। এটা ভেবেও অবাক লাগে, অতটুকু বয়সে আমিই-বা অমন একটা চিঠি লিখেছিলাম কী করে!