পূর্ণ চাঁদের আলোয় ভরা রাত। হাওরের ফসলের মাঠের ভেতর দিয়ে বইছে উত্তুরে হাওয়া। কুয়াশার ভেতর তখন কাঁসর ও ঢাকের মতো অনেক রকম বাদ্যযন্ত্র বাজাতে বাজাতে ফসলের মাঠের ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন একদল যুবক। তাঁদের ভাটিয়ালি সুর আর ছড়ার ছন্দ মিলেমিশে যাচ্ছে হাওরের বুকে। দলে আছে বাঘ সাজা যুবক, নারী সাজা পুরুষ। এই দল চলেছে আসলে বাড়ি বাড়ি থেকে চাল কুড়াতে। প্রায় ১০ দিন ধরে রোজ রাতে এমন সংগ্রহের পর ১৩ মাঘ রাতে সব চাল মিলিয়ে এক পাতিলে হবে রান্না। এর নাম ‘বাঘের শিরনি’ বা ‘মাঘের শিরনি’। সুনামগঞ্জের নিজগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক কালীকান্ত দাশ নিজের তরুণ বয়সে দেখা বাঘের শিরনি উৎসবের বর্ণনা এভাবে দিচ্ছিলেন এই প্রতিবেদকের কাছে।
শাল্লা উপজেলার কালীকান্ত দাশের বয়স এখন ৮৫ বছর। ৩ নভেম্বর ২০২৩ দুপুরে কথা হয় এই মানুষটির সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বহু প্রজন্ম ধরে বাঘের শিরনির প্রচলন শুরু হয়েছে। মানুষের বিশ্বাস, সব ঘরের চাল এক হাঁড়িতে রান্না করলে সে গ্রামে বাঘ আসে না। তবে আমরা শিরনি খাওয়ার আগে উপবাস করতাম। একসময় এ উৎসবে গাজীর উদ্দেশে ছড়া, গানও হতো।’
কালীকান্ত দাশের সুর বেসুরো হয়ে যাচ্ছিল বয়সের কারণে। পাশ থেকে এ গ্রামের আরেক বাসিন্দা ইন্দ্রজিৎ দাশ সুর করে শুনিয়ে দিলেন দুই লাইন। গাইলেন ‘সোনা বউ দিদি গো বাত্তি জ্বালাও, দরজা খোলো, ঘরের মধ্যে নড়েচড়ে কেন উঠো না?’
হাওরের এই লোকসংস্কৃতি উৎসব যেমন সব ধর্মের মানুষের, তেমনি নারী-পুরুষ সবার। তাই এ উপলক্ষে মুখে মুখে তৈরি হওয়া গানে রয়েছে নারীর কাছে চাল দেওয়ার মিনতি, আছে বাঘ আসছে বলে তাঁকে সতর্ক করার বার্তা। এই লোকজ উৎসব যে শুধু বাঘের আক্রমণ থেকে গ্রাম রক্ষার জন্য করা হতো তা নয়, হাওরের মঙ্গল কামনাও করা হতো বলে জানান সুনামগঞ্জের ধর্মপাশার শ্যামল চন্দ্র দাস। বাউলশিল্পী শ্যামাচরণ দাসের ছেলে শ্যামল মূলত ঢাক বাজান। তিনি প্রথম আলোকে বললেন, হাওরে যাতে ধান ভালো হয়, জলে মাছ ভালো হয়, সে জন্য প্রার্থনা করে শিরনি তোলা হতো। দলে নারীর উপস্থিতি না থাকলে ভারসাম্য থাকে না। রাতের উৎসবে নারীদের ঘরের বাইরে চলাফেরায় বিপদ হতে পারে, তাই পুরুষ নারী সাজে শাড়ি পরে।
ভাটি অঞ্চলের এই লোকজ উৎসব যে কৃষিনির্ভর সংস্কৃতিরও অংশ, সে গল্প বললেন হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার সাবেক ইউপি সদস্য মো. আতাউর রহমান। শৈশবে বহুবার বাঘের শিরনির চাল তুলেছেন তিনি স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে। আতাউর রহমান প্রথম আলোকে জানান, তাঁদের পাশের রঘুনন্দন গ্রামে হাওরে বাঘ নামত মাঘের শীতে। মেছো বাঘ এমনকি চিতা ছিল একসময়। চিতা বাঘকে স্থানীয় লোকজন বলতেন টিক্কাপুড়া বাঘ। অনেক সময় মানুষ দল বেঁধে মারতেন বাঘ। আতাউর রহমান বলেন, একটা উৎসব কেন্দ্র করে গ্রামের মানুষেরা এক জায়গায় হয়ে খাওয়াদাওয়া করতেন, এতে সামাজিক সম্পর্ক জোরালো হতো। বাঘের আক্রমণ থেকে গ্রাম রক্ষা হোক আর হাওরের মঙ্গল কামনা হোক, সবকিছুর মূলে ছিল আসলে গ্রামের মানুষের সংঘবদ্ধ থাকার ভাবনা।
বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলের এই লোকসংস্কৃতি উৎসবের আর এখন প্রচলন নেই। হাওর নিয়ে গবেষণা করেছেন হবিগঞ্জের মাধবপুরের সাইদুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, লোকসংস্কৃতির এত রঙিন উৎসবটি হারিয়ে যাওয়ার পেছনের অন্যতম কারণ প্রযুক্তিনির্ভরতা এবং জীবিকার জন্য মানুষের শহরমুখী হওয়ার প্রবণতা। তবে সংস্কৃতির এই দিকগুলো নিয়ে লেখা থাকলে অন্তত তথ্য সংরক্ষিত থাকে বলে উল্লেখ করলেন তিনি।
হাওর সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করছেন জলজ নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মোবারক হোসাইন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ অঞ্চলে ষোড়শ শতকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বসতি শুরুর সময় থেকে বাঘাই শিরনি উৎসবের প্রচলন হয়। মাঘ মাসের একটি নির্দিষ্ট দিনে উৎসব হওয়ার পেছনের কারণ, ওই সময়ে চাঁদের পরিপূর্ণ আলো পাওয়া যায়। তিনি বললেন, গ্রামবাংলার লোকসাংস্কৃতিক উৎসবগুলোর সঙ্গে ফসল, চাঁদের আলো, সূর্যের তাপের মতো প্রকৃতির প্রত্যক্ষ সম্পর্ক থাকে। বাঘাই উৎসবের বর্ণনা দেওয়া কালীকান্ত দাশ শেষ কবে এ উৎসব দেখেছেন, জানতে চাইলে বললেন, ‘গত ১৫–২০ বছরে আমাদের শাল্লায় সেই উৎসব আর দেখি নাই। এখন শীতের রাতে ফসলের মাঠের ভিতর দিয়ে ছেলেপিলেরা গান গাইতে গাইতে চাল কুড়াইতে যায় না। অনেকে জানেই না বাঘের শিরনি বা মাঘের শিরনি নামের কোনো উৎসব ছিল আমাদের।’