তিন দিনে আটক ৬৯ কিশোর, জামিন ৩০ জনের

‘শিশু আইনের ৪৪(৩) ধারা অনুযায়ী, গ্রেপ্তার করার পর শিশুকে কোনো অবস্থাতেই হাতকড়া বা মাজায় দড়ি বা রশি পরাতে পারবে না পুলিশফাইল ছবি: প্রথম আলো

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষের তিন দিনে (গত বুধ থেকে শুক্রবার) ৬৯ জন আটক কিশোরকে পাঠানো হয় টঙ্গী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে। এর মধ্যে বুধবার রাতেই সারা দেশ থেকে ৫১ জনকে বিভিন্ন মামলায় আটক করে কেন্দ্রটিতে পাঠানো হয়। যা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় আড়াই থেকে তিন গুণ বেশি।

নাশকতা, অগ্নিসংযোগ, বিস্ফোরক দ্রব্য তৈরি ও হত্যা মামলার আসামি হিসেবে এসব কিশোরকে আটক হয়। তবে যে ব্যাপক সংখ্যায় কিশোর আটকের ঘটনা ঘটে, সেভাবে জামিন দেওয়াও শুরু হয়েছে। শনিবার বেলা সাড়ে ৩টা পর্যন্ত ৬৯ জন কিশোরের মধ্যে ৩০ জনের জামিন হয়েছে। এর মধ্যে তিনজন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী।

আপনি তো কিশোর বলছেন! কিন্তু ভিডিও-ফুটেজ দেখেন তারা কী অবস্থা করেছে! পুলিশকে মেরে ঝুলিয়ে দিয়েছে।
আসাদুজ্জামান খান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

দেশে তিনটি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র পরিচালনা করে সমাজসেবা অধিদপ্তর। এর মধ্যে কিশোরদের জন্য টঙ্গী ও যশোরে দুটি কেন্দ্র রয়েছে। আর গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে কিশোরীদের জন্য রয়েছে একটি কেন্দ্র।

বিভিন্ন পর্যায় থেকে তথ্য নিয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে, টঙ্গী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে ওই কিশোরদের আদালতে হাজির করার পর জন্মনিবন্ধন দেখে বয়স নিশ্চিত হয়ে কেন্দ্রে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। জামিনের পর এখন সেখানে ৩৯ জন কিশোর রয়েছে। এর বাইরে আন্দোলন ঘিরে হওয়া মামলায় ১৮ জুলাই থেকে এ পর্যন্ত ১৪ থেকে ১৭ বছর বয়সী আটক চার কিশোরকে পাঠানো হয় যশোরের পুলেরহাটে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে। ওই চার কিশোরের জামিন হয়নি। অর্থাৎ দুটি কেন্দ্রে এখন মোট আটক কিশোরের সংখ্যা ৪৩।

এ ধরনের আটক যে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য করা হচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তা না হলে এত সংখ্যক কিশোর আটক হতেই পারে না।
শাহদীন মালিক, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট

গণহারে কিশোর আটকের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আপনি তো কিশোর বলছেন! কিন্তু ভিডিও ফুটেজ দেখেন, তারা কী অবস্থা করেছে! পুলিশকে মেরে ঝুলিয়ে দিয়েছে। খারাপ লাগে যে এভাবে শিশু–কিশোরদের ব্যবহার করা হয়েছে।’

অপরাধের সঙ্গে কিশোরদের যুক্ত থাকার প্রমাণ জোগাড়ের আগেই পুলিশ ব্যাপক হারে আটক করেছে বলে যে অভিযোগ রয়েছে, সে সম্পর্কে মন্ত্রী বলেন, ‘অপরাধ প্রমাণিত না হলে ছেড়ে দেওয়া হবে। কিশোরদের জামিন দিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছি আমরা।’

আরও পড়ুন

পরিবারে উৎকণ্ঠা-হাহাকার

যশোর সদর উপজেলার পুলেরহাটে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের প্রধান ফটক
ছবি: প্রথম আলো
কিশোরদের অভিভাবকেরা বলছেন, তাঁরা উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। হত্যা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও বিস্ফোরক দ্রব্য তৈরির মতো বড় ধরনের মামলায় আটক হওয়ায় তাঁদের সন্তানেরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে।

কিশোরদের অভিভাবকেরা বলছেন, তাঁরা উদ্বেগ–উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। হত্যা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও বিস্ফোরক দ্রব্য তৈরির মতো বড় ধরনের মামলায় আটক হওয়ায় তাঁদের সন্তানেরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। এমন অবস্থায় সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁরা চিন্তিত।

টঙ্গী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে আটক ১৭ বছর ৩ মাস বয়সী এক কিশোরকে যাত্রাবাড়ীতে পুলিশ হত্যা মামলার আসামি হিসেবে ২৪ জুলাই রাত একটার দিকে বাসা থেকে আটক করা হয়। ওই কিশোরের বাবা গত বুধবার এই প্রতিবেদককে বলেন, তাঁর ছেলেকে আটক করে হাতকড়া ও দড়ি পরিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। বয়স প্রমাণের পর সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হলে আদালত তাঁর ছেলেকে কারাগারে না পাঠিয়ে টঙ্গী কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠান। কথা বলার এক পর্যায়ে ব্যাংক কর্মকর্তা ওই বাবা ডুকরে কেঁদে ওঠেন। তিনি বলেন, ‘আমি আর আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েছি। সারা রাত ঘুমাতে পারি না। কথা বলতেও কষ্ট হয়।’

মিরপুর ১০ নম্বরের রাস্তা থেকে ১৬ বছর ১০ মাস বয়সী আরেক কিশোরকে হাতকড়া ও দড়ি পরিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। এ ঘটনায় কিশোরের পরিবার এতই ভীত যে তাঁরা সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। কিশোরের মামলা নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করছেন এমন এক ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেন, ওই কিশোরের জামিনও নাকচ হয়েছে। ভাঙচুরের মামলায় গত সোমবার তাকে আটক করে মিরপুর মডেল থানায় রাখা হয়। পরদিন আদালত টঙ্গী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠান তাদের।

পিএইচডির প্রয়োজনে ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তিনটি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে তথ্য সংগ্রহের কাজ করেছিলেন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সুহেলী সায়লা আহমদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নিরপরাধ শিশুদের এভাবে আটক কোনোভাবে কাম্য নয়। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির শিকার শিশু–কিশোরদের ভবিষ্যতে ব্যক্তিত্ব বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সামাজিকভাবে কেউ কেউ অপরাধী তকমা দিতে পারে। এর ফলে কিশোরের স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হতে পারে।

আরও পড়ুন

ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরিতে এ আটক

শিশু আইন ২০১৩ (সংশোধিত ২০১৮)–এর ৪৪ ধারায় গ্রেপ্তার, তদন্ত, বিকল্প পন্থা ও জামিন শিরোনামের অধ্যায়ে শিশুদের বিষয়ে বেশ কিছু নির্দেশ দেওয়া রয়েছে। এই ধারার উপধারা ৩ অনুসারে, শিশুকে গ্রেপ্তার করার পর গ্রেপ্তারকারী পুলিশ কর্মকর্তা গ্রেপ্তারের কারণ, স্থান, অভিযোগের বিষয়বস্তু ইত্যাদি সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে শিশুবিষয়ক পুলিশ কর্মকর্তাকে অবহিত করবেন এবং প্রাথমিকভাবে তাঁর বয়স নির্ধারণ করে নথিতে লিপিবদ্ধ করবেন। তবে শর্ত থাকে যে গ্রেপ্তার করার পর কোনো শিশুকে হাতকড়া বা কোমরে দড়ি বা রশি লাগানো যাবে না।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরির জন্য গায়েবি মামলায় বিপুলসংখ্যক কিশোরকে আটক করা হয়েছে। এভাবে কিশোর আটক সম্পূর্ণ বেআইনি এবং শিশু আইন ২০১৩–এর পরিপন্থী।

সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী আরও বলেন, পুলিশ হাজার হাজার গ্রেপ্তার করছে। এত সংখ্যক আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য–প্রমাণের ভিত্তিতে অভিযোগপত্র দেওয়া পুলিশের পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। এ ধরনের আটক যে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য করা হচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তা না হলে এত সংখ্যক কিশোর আটক হতেই পারে না।