১৬ জুলাই প্রথম আলো অনলাইনে ‘কোরবানির গরু, মাংসের দাম ও গরুবিষয়ক সরকারি নীতি’ লেখাটা চোখে পড়ামাত্রই পড়ে ফেললাম। পুরো লেখায় গরুর মাংসের দাম যে অত্যধিক এবং মানুষের নাগালের বাইরে, এ বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।
আমার লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করছি মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করার পরও কেন দেশে মাংসের দাম বেশি? নীতিমালায় কোথাও পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করার প্রয়োজন আছে কি না, ভবিষ্যতের জন্য কী করণীয়—এ বিষয়গুলোর ওপরও আলোকপাতের চেষ্টা করব।
জনগণের কাছে কম দামে খাদ্য পৌঁছে দেওয়া একটি দেশের সরকারের অন্যতম প্রধান কাজ। সে ক্ষেত্রে দৈনিক খাদ্যতালিকায় আমিষের উৎস হিসেবে গরুর মাংস একটি প্রয়োজনীয় পদ। দেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষের উৎসের ৩০ শতাংশ আসছে পোলট্রি খাত থেকে, ২৫ শতাংশ আসছে গবাদিপশু থেকে এবং ৪৫ শতাংশ আসছে মাছ থেকে। দেখা যাচ্ছে, দেশে মাছ ও মুরগি আমিষের বড় অংশের চাহিদা পূরণ করে। তবে গরু ও খাসির মাংস মানুষের আমিষের জন্য জরুরি। দাম অত্যধিক হওয়ায় অনেকের কাছে তা সহজলভ্য নয়।
বিশ্বজুড়ে বেড়েছে গরুর মাংসের দাম
২০২০ ও ২০২১ সালে বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারির প্রভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। তবে জিনিসপত্রের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে চলতি বছরের প্রথম দিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর।
বাংলাদেশে গোখাদ্যে আমিষের উৎস হিসেবে সয়ামিল ও শর্ষের খইল ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গোখাদ্যের উপকরণের দাম বেড়েছে। এতে দেশে গোখাদ্যের দাম ২০ শতাংশের মতো বেড়েছে।
২০১৯ ও ২০২০ সালে দেশে গরুর মাংসের প্রতি কেজির দাম ছিল ৫৮০ থেকে ৬০০ টাকা। কিন্তু গত এক বছরে মাংসের দাম বেড়ে ৬৮০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি হয়েছে। বিশ্ববাজারের দিকে তাকালে দেখা যাবে, যুক্তরাষ্ট্রে গরুর মাংসের কেজি ১৩ দশমিক ৬৩ মার্কিন ডলার, অস্ট্রেলিয়ায় ১৩ দশমিক ২৪ ডলার, যুক্তরাজ্যে ১০ ডলার, পাকিস্তানে ৩ দশমিক ৬০ ডলার এবং ভারতে ৫ দশমিক ৯১ ডলার। ১ ডলার সমান ৯৫ টাকা ধরে হিসাব করলে দেখা যাবে, ইউরোপ ও আমেরিকায় মাংসের দাম বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি। তবে ভারত ও পাকিস্তানে কম। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশে গরুর মাংসের দাম বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ।
দেশে কেন দাম বেড়েছে
বাংলাদেশে গরুর মাংসের দাম বাড়ার মূল কারণ গোখাদ্যের দাম। ২০২১ সালে ভারতে সয়ামিল (সয়াবিনের উপজাত) রপ্তানির সুযোগ দেওয়ার কারণে এক দিনের মধ্যে সব ধরনের গোখাদ্যের দাম বেড়েছিল ১৮ থেকে ২০ শতাংশ। দেশের চাহিদা না মিটিয়ে ভারতে সয়ামিল রপ্তানির অনুমতি দেওয়া ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত।
বাংলাদেশে গোখাদ্যে আমিষের উৎস হিসেবে সয়ামিল ও শর্ষের খইল ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গোখাদ্যের উপকরণের দাম বেড়েছে। এতে দেশে গোখাদ্যের দাম ২০ শতাংশের মতো বেড়েছে।
আমাদের দুর্ভাগ্য, শুধু সয়ামিল ভারতে রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হলেও গোখাদ্যের সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে গমের ভুসি, রাইস পলিশ (চালের উপজাত), ভুট্টাসহ সব উপকরণের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। সাময়িক সমস্যার কারণে বাংলাদেশে কোনো পণ্যের দাম যদি একবার বাড়ানো হয়, পরে সেই দাম আর আগের অবস্থায় ফিরে আসে না। গোখাদ্যের ক্ষেত্রে এর কারণ, দেশে চার থেকে পাঁচজন বড় আমদানিকারক বাজারটি নিয়ন্ত্রণ করেন।
মাংসের দাম কমানো সম্ভব
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ—এগুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরীণ কয়েকটি বিষয় আছে, যেগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ ও নজর দিলে গরুর মাংসের দাম ২০ শতাংশ কমানো সম্ভব। এতে বাজারে প্রতি কেজি গরুর মাংস ৫৫০ থেকে ৫৮০ টাকায় পাওয়া যাবে। সে ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছাই একমাত্র জরুরি।
যে বিষয়গুলোর ওপর নজর দিতে হবে
১. গরুর খামারের বিদ্যুৎ বিল আদায় করতে হবে কৃষির সমান হারে, বাণিজ্যিক খাত হিসাবে নয়। কারণ, খামার করা আসলে কৃষিকাজ।
২. সরকারের প্রাণিসম্পদ নীতিমালা খামারিবান্ধব নয়। এ কারণে বড় বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যাঁরা বড় বিনিয়োগ করেছেন, তাঁরাও সুবিধা করতে পারছেন না। বিশ্বে অধিক মাংস উৎপাদনকারী গবাদিপশুর জাত, যেমন: আমেরিকান ব্রাহমা, দক্ষিণ আফ্রিকার বয়ার গোট, দুম্বা দেশে আনার অনুমতি নেই। দেশীয় জাত অথবা সংকর জাতের গরু দিনে ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাম পর্যন্ত ওজনে বাড়ে। অন্যদিকে, ব্রাহমা জাতের গরুর ওজন বাড়ে প্রতিদিন ১ হাজার গ্রামের বেশি।
দেশীয় ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলের ওজন দৈনিক ৩০ থেকে ৫০ গ্রাম করে বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে, দক্ষিণ আফ্রিকার বয়ার বাড়ে দিনে ১০০ থেকে ১৫০ গ্রাম। ফলে মাংস উৎপাদনের ব্যয় অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে অনেক বেশি। আমদানি করতে না দেওয়ার কারণ হিসেবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে বলা হয়, দেশীয় জাত নষ্ট হয়ে যেতে পারে, তাদের সেই আশঙ্কা রয়েছে। অধিক মাংসের জাত দেশে আনা হলে দুধ উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে।
প্রশ্ন থেকে যায়, সরকারি প্রতিষ্ঠান প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কি আদৌ জনগণের কাছে কম দামে মাংস পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে?
দেশীয় জাতের সুরক্ষা দিতে গিয়ে খাসির মাংস প্রতি কেজি ১ হাজার টাকা ও গরুর মাংস ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এটা সত্যিই হাস্যকর! পাশাপাশি এই সন্দেহও তৈরি হয় যে আমরা কি আড়ালে মাংস আমদানিকেই উৎসাহিত করছি।
৩. গোখাদ্যে আমিষের উৎস হিসেবে ‘মিট বোন মিল’ আমদানি শুরু করতে হবে। মিট বোন মিল মৎস্য ও পোলট্রিশিল্পের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এটা আমদানি শুরু হলে সয়াবিনের ওপর চাপ কমে যাবে এবং দাম কমতে শুরু করবে। দেশে মিট বোন মিল মিল তৈরির কারখানা করতে হবে। কারখানা করতে সরকার থেকে প্রণোদনা দেওয়া উচিত।
৪. খামারিরা মাংস উৎপাদন করে মুনাফা করতে না পারলেও মধ্যস্বত্বভোগীরা ভালো লাভ করতে পারেন। এতে একদিকে খামারিরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন, অন্যদিকে ক্রেতাদের বেশি দামে মাংস কিনতে হচ্ছে। কোনো পক্ষই যেন অধিক মুনাফা করতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতে কোরবানির গরু বাদে অন্য ক্ষেত্রে গবাদিপশু কেনাবেচায় ডিজিটাল স্কেল বা ওয়েট স্কেল ব্যবহার করতে হবে। দাম নির্ধারণ করে ডিজিটাল স্কেলের মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে কীভাবে কেনাবেচা সম্পন্ন করা যায়, সে বিষয়ে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে।
৫. সিন্ডিকেট কোনোভাবেই যেন দাম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, সে জন্য সরকারকে আমদানি করা গোখাদ্যের দাম বেঁধে দিতে হবে এবং বিনা কারণে অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
৬. দেশে পতিত খাসজমি খামারিদের ইজারা দেওয়া যেতে পারে ঘাস উৎপাদনের জন্য।অধিক ঘাস উৎপাদনের ফলে দানাদার খাদ্যের ওপর চাপ কমিয়ে মাংসের উৎপাদন খরচ কমানো যেতে পারে।
৭. জাত সিলেকশনে খামারিদের হাত–পা বাঁধা অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সরকারি নীতিমালায় ফ্রিজিয়ান ছাড়া কোনো জাতের গরু আমদানির অনুমতি নেই। ঠান্ডা দেশের জাত ফ্রিজিয়ান গরু ঠান্ডা দেশেই ভালোভাবে টিকে থাকতে পারে। কিন্তু গরমের দেশে এ জাতকে আনার কারণে রোগবালাই সার্বক্ষণিক লেগেই থাকে একটি খামারে, এ কারণে মাংস ও দুধের উৎপাদন খরচ স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি। বাংলাদেশে আবহাওয়ার সঙ্গে মানানসই ব্রাহমা, জার্সি, গির, ফ্লেকভি জাতগুলো দেশে আনার অনুমতি নেই। এসব জাতকে আমদানির অনুমতি দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে বড় বিনিয়োগের উৎপাদনে সহযোগিতা করতে পারলেই মাংসের উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনা সম্ভব।
শাহ এমরান, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশন