প্রথম আলো: আপনি রোবোটিক সার্জারির ওপর প্রশিক্ষণ শেষ করে সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন। এই সার্জারি সম্পর্কে আমাদের সহজভাবে বুঝিয়ে বলুন।
সরকার কামরুন জাহান: রোবোটিক সার্জারি হচ্ছে রোবটের মাধ্যমে করা অস্ত্রোপচার। মূল কাজটি করেন একজন সার্জন। তিনি মনিটরের মাধ্যমে দেখে সব নির্দেশ দেন। সার্জনের হাত হিসেবে দায়িত্বটি পালন করে রোবট। রোবট বললেই যেমন একটা দৃশ্য আমাদের চোখে ভেসে ওঠে, ব্যাপারটা তেমন নয়। এটা একটা যন্ত্র, যার ভেতরে নির্দেশ পেয়ে সেই নির্দিষ্ট কাজ করার সিস্টেম সেট করা আছে। আমাদের দেশে এখন ল্যাপারোস্কপি হয় অনেক হাসপাতালেই। এ প্রক্রিয়ায় রোগীর শরীরে কয়েকটি ছিদ্র করে যন্ত্র প্রবেশ করিয়ে কাজটি সম্পন্ন হয়। আর রোবোটিক অস্ত্রোপচারে একটিমাত্র ছিদ্র হবে। যত বড় অস্ত্রোপচারের প্রয়োজনই হোক, এই নিয়মে মাত্র একটি ছিদ্র দিয়ে তা করা হবে। এক বাক্যে এটা সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অস্ত্রোপচার।
প্রথম আলো: কোন কোন ধরনের অস্ত্রোপচার সম্ভব?
সরকার কামরুন জাহান: যেকোনো অস্ত্রোপচার, যেটা ল্যাপারোস্কপিতে করা সম্ভব, সেটাই করা যাবে।
পিত্তথলির পাথর অপসারণ, অ্যাপেনডিসাইট, এমনকি থাইরয়েড ক্যানসার বা গ্ল্যান্ডের অস্ত্রোপচার হয় রোবোটিক সার্জারিতে। গ্ল্যান্ডে অস্ত্রোপচার হলে রোগীর গলায় কাটা দাগ দেখা যায় সব সময়। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় কোনো দাগ দেখা যাবে না।
এ সার্জারির কয়েকটি ভালো দিক আছে। প্রথমত, চিকিৎসক ও রোগীর জন্য সময় কম প্রয়োজন হয়।
চিকিৎসকের নিজের দুই হাতের ওপর চাপ কম পড়ে বলে তিনি আরও বেশি মনোনিবেশ করতে পারেন।
অন্যদিকে রোগী দ্রুত সুস্থ হন। সেলাই শুকানোর জন্য অপেক্ষা করতে হয় না।
দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তির সাহায্যে শরীরে মাত্র একটি ছিদ্র করে অস্ত্রোপচার হয় বলে রক্তক্ষরণের আশঙ্কা একেবারেই থাকে না। রোগীর ব্যথা কম হয়। শরীরে দাগ থাকে না।
তৃতীয়ত, রোবোটিক সার্জারি একটি ‘নন-টাচ’ (ছোঁয়াবিহীন) কৌশল, তাই সংক্রমণের ঝুঁকি একেবারেই নেই, যেটা সাধারণ অস্ত্রোপচারে কখনো কখনো ঘটে এবং এতে রোগী ভুক্তভোগী হন। শোনা যায়, সেলাই শুকায় না বা অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি থেকে সংক্রমণ ঘটেছে।
প্রথম আলো: সংক্রমণের ভয় কম, রক্তক্ষরণ কম বোঝা গেল। এ ধরনের অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জটিল সমস্যাগুলোর কি তাৎক্ষণিকভাবে সমাধান করা যাবে?
সরকার কামরুন জাহান: নিশ্চয়ই। চিকিৎসক নিজেই তো মনিটরে রোগীর সম্পূর্ণ পরিস্থিতি দেখতে পারেন। তিনি যেভাবে নির্দেশ দেবেন, সেভাবেই কাজ করবে যন্ত্র। বরং আরও বেশি সম্ভব।
ল্যাপারোস্কপির জন্য যে যন্ত্র ব্যবহার হয়, তা হয় সোজা ধরনের। কিন্তু রোবোটিক সার্জারিতে ব্যবহার করা যন্ত্রগুলো ফ্লেক্সিবল। যেকোনোভাবে বাঁকা করে এটি দিয়ে কাজ করানো সম্ভব। এর মনিটরে শরীরের ভেতর ৩৬০ ডিগ্রি পর্যন্ত দেখায়। ফলে চিকিৎসক সহজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।
প্রথম আলো: আপনি কত দিনের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন?
সরকার কামরুন জাহান: সরকারি চিকিৎসকদের ছুটির একটি সময়সীমার ব্যাপার আছে, আপনারা জানেন। প্রশিক্ষণটি অন্তত ছয় মাসের হয়। আমার ছয় মাসের ফেলোশিপ কোর্সটি চার মাসে আনা হয়েছিল। তিন মাসের প্রশিক্ষণ এবং এক মাসের কাজ ছিল গবেষণাপত্র তৈরির। গবেষণার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অক্সফোর্ড রোবোটিক ইনস্টিটিউটে সাত দিনের উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিতে হয়। সব পর্বে উত্তীর্ণ হওয়ার পর দক্ষিণ কোরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে রোবোটিক সার্জারি ফেলোশিপের সনদ প্রদান করে।
প্রথম আলো: রোবোটিক সার্জারির প্রযুক্তি বাংলাদেশে এখনো আসেনি। প্রশিক্ষণ থেকে কেমন সুফল আসবে বলে মনে করেন?
সরকার কামরুন জাহান: একদিন এ দেশে ল্যাপারোস্কপিও ছিল না। এখন অনেক হাসপাতালেই করা হয়। বহু রোগীর হাতের নাগালে এসেছে এর খরচ। বিশ্বে প্রথম ল্যাপারোস্কপি শুরু হয় ১৯৮৫ সালে।
বাংলাদেশে শুরু হয় ছয় বছর পর, ১৯৯১ সালে। রোবোটিক সার্জারি আমেরিকায় শুরু হয়েছে ২০০০ সাল থেকে। আমাদের দেশে এখনো হয়নি, তবে একদিন নিশ্চয়ই শুরু হবে। যত দ্রুত সম্ভব শুরু হওয়া উচিত। সেটা হবে আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থায় এগিয়ে যাওয়ার অনেক বড় পদক্ষেপ।
বিএসএমএমইউর (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) উপাচার্য শারফুদ্দিন আহমেদ স্যার চেষ্টা করছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ বি এম খুরশীদ আলম স্যারও অস্ত্রোপচারের জন্য দেশে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে যথেষ্ট আগ্রহী। তাঁদের চেষ্টাতেই হয়তো ত্বরান্বিত হবে এ প্রক্রিয়া। তবে বড় সংকট হচ্ছে যন্ত্রপাতি আনা এবং সেটা ব্যবহারের জন্য স্থাপন করা। রোবোটিক সার্জারির যন্ত্রপাতি ব্যয়বহুল। অবশ্য যেকোনো প্রযুক্তিই প্রথমে স্থাপন করা ব্যয়বহুল ব্যাপার। এরপর দীর্ঘ মেয়াদে তা আর এমন থাকে না। ল্যাপারোস্কপির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ছিল। আপনি বলছিলেন প্রযুক্তির ব্যবস্থা নেই, তাহলে এই প্রশিক্ষণ নিয়ে কী লাভ।
এখন যদি রোবোটিক সার্জারির জন্য যন্ত্র স্থাপন করা হয়, তাহলেই অস্ত্রোপচার সম্ভব হবে? এর জন্য প্রশিক্ষিত চিকিৎসক প্রয়োজন হবে না? এটা প্রযুক্তির সঙ্গে চিকিৎসকের দক্ষতাকে এগিয়ে রাখা।
প্রথম আলো: কেউ কেউ বলছেন, আপনি বাংলাদেশের প্রথম রোবোটিক সার্জারির পাসপোর্টের সনদপ্রাপ্ত চিকিৎসক। বাংলাদেশে আগে কেউ এই সনদ পায়নি?
সরকার কামরুন জাহান: এখানে একটা প্রসঙ্গ উল্লেখ প্রয়োজন। আমি সনদ পেয়েছি। এতে বিশ্বের যে ৬৭টি দেশে এই প্রক্রিয়ায় চিকিৎসা করা সম্ভব হয়, সেখানে গিয়ে রোবোটিক সার্জারিতে অংশ নিতে পারব। বাংলাদেশ থেকে আমি প্রথম করেছি কি না, নিশ্চিত বলতে পারব না। তবে দক্ষিণ কোরিয়ায় আমার প্রশিক্ষণ শেষে সনদ দেওয়ার সময় তারা ভীষণ অবাক হয়ে আমাকে বলেছিল, রোবোটিক সার্জারির প্রশিক্ষণ শেষ করা বাংলাদেশের আর কোনো চিকিৎসকের নাম তারা এর আগে তালিকায় পায়নি।
প্রথম আলো: এই প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে আপনাকে গবেষণা করতে হয়েছে। সে সম্পর্ক বলুন।
সরকার কামরুন জাহান: সারা বিশ্বে এখন ৫ হাজার ৯৮৯টি রোবোটিক সার্জারি প্রশিক্ষণকেন্দ্র আছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে আধুনিক যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটার নাম ‘দ্য ভিঞ্চি এসপি’ সিস্টেম। কোরিয়া ইউনিভার্সিটি আনাম হাসপাতালের দ্য ভিঞ্চি এপিসেন্টার থেকেই আমি প্রশিক্ষণ নিয়েছি, যেখানে এই দ্য ভিঞ্চি এসপি সিস্টেম নিয়েই পড়ানো হয়েছে। চার মাসের ফেলোশিপের এক মাস ছিল গবেষণার। আমার থিসিসের শিরোনাম ‘কম্প্যারিজন অব আউটকাম অব রোবোটিক সিঙ্গেল পোর্ট কলিসিস্টেকটমি অ্যান্ড মাল্টিপোর্ট ল্যাপারোস্কপিক কলিসিস্টেকটমি’। এতে তিন শতাধিক রোবোটিক সার্জারির ঘটনাকে কেস স্টাডি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
প্রথম আলো: পেশার শুরুতে আপনার পোস্টিং ছিল প্রত্যন্ত গ্রামে। রোবোটিক সার্জারি ও প্রত্যন্ত গ্রামের একজন রোগীর চিকিৎসা পাওয়ার সুবিধাকে কীভাবে তুলনা করবেন?
সরকার কামরুন জাহান: আমি ৩৩তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হই। প্রথম পোস্টিং ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস, সার্জারিতে এফসিপিএস এবং এমসিপিএস করে লন্ডন থেকে এমআরসিএস সম্পন্ন করেছি। এরপর ইংল্যান্ডের রয়্যাল কলেজ অব সার্জন থেকে মিনিম্যালি ইনভেসিভ সার্জারিতে বিশেষজ্ঞ উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেওয়া হয়েছে। আমি কাজ করি সরকারি হাসপাতালে। সরকারি হাসপাতালগুলোয় রোগীদের মধ্যে দেখবেন একটু অসহায় মানুষ বেশি। যাঁরা কোথাও চিকিৎসা করাতে পারেন না, তাঁদেরও জায়গা হয় সরকারি হাসপাতালে। ফলে এখানে আসা মানুষের আর্থিক সংগতি নিয়ে ভাবতে হয় আমাদেরও। এই মানুষদের সাধ্য সত্যি খুব সীমিত। কিন্তু সীমিত সংগতি বলে তাঁরা উন্নত চিকিৎসা থেকে কেন বঞ্চিত হবেন?
আমি এখন যেখানে দায়িত্ব পালন করছি, এখানে ল্যাপারোস্কপির জন্য কোনো আলাদা টাকা নেওয়া হয় না। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালে কি সেটা সম্ভব? রোবোটিক সার্জারিও প্রথমে ব্যয়বহুল হবে ঠিকই, কিন্তু একসময় দেখবেন সেই কসবা থেকে আসা মানুষটিও সরকারি হাসপাতালে এসে নিজের শরীর না কেটে এই চিকিৎসাসেবা নিয়ে যেতে পারবেন। বাংলাদেশকে রোবোটিক সার্জারির দিকে যেতেই হবে। আমরা স্বপ্নটা এভাবেই দেখতে চাই।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
সরকার কামরুন জাহান: আপনাকেও ধন্যবাদ।